নোটিশ

শুক্রবার, ২০ জানুয়ারী, ২০১২

কারবালার হৃদয় বিদারক ইতিহাস (৪)

হযরত ইমাম মুসলিম বিন আক্বীল রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর প্রতি প্রাণঢালা সংবর্ধনা

কূফায় পৌঁছে মুখতার বিন উবায়দুল্লাহ সাকফী, যে আমন্ত্রণকারীদের মধ্যে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিল ও আহলে বাইত-এর অনুরক্ত ছিল, তার ঘরেই হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি তাশরীফ রাখলেন। যখন কূফাবাসীরা খবর পেল যে, হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম এর প্রতিনিধি হয়ে এসেছেন। তখন কূফাবাসীরা দলে দলে এসে তাঁর হাতে বাইয়াত হতে লাগলো। অল্প দিনের মধ্যে চল্লিশ হাজার লোক তাঁর হাতে বাইয়াত হয়ে গেল এবং এমন ভালবাসা ও মুহব্বত দেখালো যে, হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি অভিভূত হয়ে গেলেন। তাঁর পিছে পিছে লোক চলাফেরা করছে, দিন-রাত মেহমানদারী করছে, তাঁর হাতে-পায়ে চুম্বন করছে এবং একান্ত আনুগত্যের পরিচয় দিচ্ছে।
এতে হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি ভীষণভাবে আকৃষ্ট হলেন এবং মনে মনে বললেন, এরাতো সত্যিই হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার বড়ই আশিক এবং উনার জন্য একেবারে ফানা। তিনি ভাবলেন, আমাকে পেয়ে তাদের যে অবস্থা হয়েছে, জানিনা, হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম আসলে তারা কী যে অবস্থা করবে। হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি এভাবে পরিতৃপ্ত হয়ে সমস্ত অবস্থার বর্ণনা দিয়ে হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার কাছে চিঠি লিখলেন- "চল্লিশ হাজার লোক আমার কাছে বাইয়াত হয়েছে, সব সময় আমার সাথে সাথে রয়েছে, আমার যথেষ্ট খিদমত করছে এবং তাদের অন্তরে আপনার প্রতি অসীম মুহব্বত রয়েছে। তাই আপনি আমার চিঠি পাওয়া মাত্রই চলে আসুন। এখানকার অবস্থা খুবই সন্তোষজনক।" এভাবে হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার নিকট চিঠি লিখলেন। এদিকে পত্র-বাহক পত্র নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেল। আর ঐদিকে দেখুন, তকদীরে যা লিখা ছিল, তা কিভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে।


কূফাবাসীর বেঈমানী

ইয়াযীদের অনুসারীদের মধ্যেও অনেকে কূফায় অবস্থান করতো। তারা যখন দেখলো, হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি -এর হাতে চল্লিশ হাজার লোক বাইয়াত গ্রহণ করেছে, তখন তারা ইয়াযীদকে এ ব্যাপারটা জানিয়ে উস্কানীমূলক চিঠি দিল। তারা ইয়াযীদকে লিখলো যে, ওহে ইয়াযীদ! তুমিতো নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছো, আর এদিকে তোমার বিরুদ্ধে কূফায় বিদ্রোহ দানা বেঁধে উঠছে, যা তোমার পক্ষে প্রতিরোধ করা খুবই কষ্টসাধ্য হবে। তোমারতো খবরই নেই, তোমার বিরুদ্ধে চল্লিশ হাজার লোক বাইয়াত হয়েছে এবং আরও লোক বাইয়াত হচ্ছে। যদি এভাবে চলতে থাকে, তাহলে এখান থেকে এমন এক ভয়ানক ঝড়-তুফানের সৃষ্টি হবে, যা তোমাকে খড়-কুটার ন্যায় উড়িয়ে নিয়ে যাবে। তাই তুমি যেভাবেই হোক এটাকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করো।যখন ইয়াযীদ চিঠির মাধ্যমে এ খবর পেল, সে খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হলো। সে অবহিত আছে যে, রাজ-ক্ষমতা বড় জিনিস। কেউ নিজ ক্ষমতা সহজে ত্যাগ করতে চায় না। আপ্রাণ চেষ্টা করে সেই ক্ষমতা, সেই সিংহাসন আঁকড়ে রাখতে চায়। তাই ইয়াযীদের কাছেও যখন তার রাজত্ব হুমকির সম্মুখীন মনে হলো, তখন কূফার গভর্নর নোমান বিন বশীরযিনি হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি -এর বিরুদ্ধে কোন প্রতিকার নেননি, তাকে পদচ্যূত করলো এবং তার স্থলে ইবনে যিয়াদ যার আসল নাম ছিল উবাইদুল্লাহযে বড় যালিম ও কঠোর ব্যক্তি ছিল এবং যে বছরার গভর্নর ছিল, তাকে কূফার গভর্নর নিয়োগ করলো এবং তার কাছে চিঠি লিখলো- তুমি বছরার গভর্নরও থাকবে, সাথে সাথে তোমাকে কূফারও গভর্নর নিয়োগ করা হলো। তুমি শীঘ্রই কূফা এসে আমার বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহের সৃষ্টি হয়েছে, তা যেভাবে হোক দমিয়ে ফেলো, এ ব্যাপারে যা করতে হয়, তা করার জন্য তোমাকে পূর্ণ ইখতিয়ার দেয়া হলো। যেভাবেই হোক, যে ধরনের পদক্ষেপই নিতে হোক না কেন, এ বিদ্রোহকে নির্মূল করে দাও।ইবনে যিয়াদ ইয়াযীদের পক্ষ থেকে পূর্ণ ক্ষমতা নিয়ে কূফায় আসলো। সে কূফায় এসে সর্বপ্রথম যে কাজটা করলো, তা হচ্ছে যতগুলো বড় বড় সর্দার ছিল এবং যারা হযরত মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর সাথে ছিল ও বাইয়াত গ্রহণ করেছিল, তাদের সবাইকে বন্দী করে ফেললো এবং বন্দী করার পর কূফার গভর্নর হাউজে নজরবন্দী করে রাখলো। তাদের এই বন্দীর কথা বিদ্যুৎ বেগে সমগ্র কূফায় ছড়িয়ে পড়লো এবং এতে সমস্ত লোক হতভম্ব ও মর্মাহত হলো। সবাই চিন্তিত হলো, এখন কি করা যায়? সমস্ত বড় বড় সর্দারকে বন্দী করছে এবং অনেককে বন্দী করে ফেলেছে। এমনকি হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহিকেও বন্দী করার কৌশল নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছে।
যখন হযরত মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি দেখলেন যে, বড় বড় সর্দারদেরকে বন্দী করা হয়েছে এবং আরও নতুন-নতুন বন্দী করার জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে, তখন তিনি তাঁর সমস্ত অনুসারী ও বাইয়াত গ্রহণকারীদের আহবান করলেন। তাঁর ডাকে সাথে সাথে সবাই এসে সমবেত হয়ে গেল। ঐ চল্লিশ হাজার ব্যক্তি যারা তাঁর হাতে বাইয়াত করেছিল, তারা সবাই সমবেত হলো। তিনি তাদের হুকুম দিলেন, গভর্নর ভবন ঘেরাও করো। হযরত মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি সেই চল্লিশ হাজার অনুসারীদেরকে নিয়ে গভর্নর ভবন ঘেরাও করলেন। তখন অবস্থা এমন উত্তপ্ত ছিল, তিনি একটু ইশারা করলে ঐ চল্লিশ হাজার লোক এক মূহূর্তের মধ্যে গভর্নর ভবন ধুলিস্যাৎ করে ফেলত এবং ইবনে যিয়াদ এর কোন প্রতিরোধ করতে পারতো না। কারণ, ঐ চল্লিশ হাজার লোকের মোকাবেলা করার ক্ষমতা তখন তার ছিল না। এমনকি তখন তার কাছে এত সৈন্যও ছিল না। হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি যখন চল্লিশ হাজার লোক নিয়ে গভর্নর ভবন ঘেরাও করলেন, তা দেখে ইবনে যিয়াদ খুবই ভয় পেল। তবে সে চালাকী ও ধোঁকাবাজির আশ্রয় নিল। যেসব বড় বড় সর্দারদেরকে গভর্নর ভবনে নজরবন্দী করে রাখা হয়েছিল, তাদের সবাইকে একত্রিত করে বললো, দেখুন আপনারা যদি আপনাদের পরিবার-পরিজনের মঙ্গল চান তাহলে আমার পক্ষ অবলম্বন করুন। আমাকে সহযোগিতা করুন। নচেৎ আমি আপনাদেরকে হত্যা করার নির্দেশ দিব এবং আপনাদের পরিবারের ও আপনাদের সন্তান-সন্ততিদের যে কঠিন পরিণতি হবে, তা দুনিয়াবাসী দেখবে। অতঃপর বড় বড় সর্দারেরা বললো, আপনি কি চান? কি ব্যাপারে আমাদের সহযোগিতা চান? ইবনে যিয়াদ বলল- যারা এ মুহূর্তে গভর্নর ভবন ঘেরাও করে রেখেছে, তারা হয়তো আপনাদের ছেলে হবে বা ভাই হবে বা অন্য আত্মীয় স্বজন হবে। আমি এখন আপনাদেরকে গভর্নর ভবনের ছাদের উপর উঠাচ্ছি, আপনারা নিজ নিজ আপনজনদেরকে ডেকে বুঝান, যেন তারা ঘেরাও প্রত্যাহার করে নেয় এবং হযরত মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর সঙ্গ ত্যাগ করে। যদি আপনারা এই রকম না করেন, তাহলে সবার আগে আপনাদের হত্যা করার নির্দেশ দিব এবং অতি সহসা আমার যে সৈন্য বাহিনী আসছে তারা কূফা আক্রমণ করবে, আপনাদের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হবে এবং আপনাদের শিশুদেরকে বর্শার অগ্রভাগে উঠানো হবে অর্থাৎ আপনাদের কঠিন অবস্থার সম্মুখীন হতে হবে। তাই আমি আপনাদেরকে বলছি- আমার পক্ষ অবলম্বন করুন, যদি নিজের এবং পরিবার পরিজনের মঙ্গল চান।

এভাবে যখন সে হুমকি দিল তখন বড় বড় সর্দারেরা ঘাবড়িয়ে গেল এবং সবাই বলতে লাগল, ইবনে যিয়াদ! আপনি যা করতে বলেন আমরা তাই করবো। ইবনে যিয়াদ বললো, চলুন, ছাদে উঠুন এবং আমি যেভাবে বলি সেভাবে করুন। সর্দারেরা সাথে সাথে ছাদের উপর উঠলো এবং নিজ নিজ আপনজনদেরকে ডাকতে লাগলো। ডেকে চুপি চুপি বুঝাতে লাগলো, দেখ, ক্ষমতা এখন ইয়াযীদের হাতে, সৈন্য বাহিনী ইয়াযীদের হাতে, অস্ত্র-শস্ত্র, ধন-সম্পদ ইয়াযীদের হাতে। হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম অবশ্যই রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বংশধর। কিন্তু তাঁর কাছে না আছে রাজত্ব, না আছে সম্পদ, না সৈন্য-সামন্ত, না অস্ত্র-শস্ত্র। তাই তিনি সৈন্য-সামন্ত, অস্ত্র-শস্ত্র ও ধন সম্পদ ব্যতিরেকে কিভাবে ইয়াযীদের মোকাবিলা করবেন? মাঝখানে আমরা বিপদগ্রস্ত হবো। এটা রাজনৈতিক ব্যাপার। তাই তোমরা এখন এ ঘেরাও উঠিয়ে নাও এবং হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর সঙ্গ ছেড়ে দাও। স্মরণ রেখ, তোমরা যদি এরকম না করো, তাহলে না তোমরা আমাদের মুখ দেখবে আর না আমরা তোমাদের মুখ দেখবো। আমাদেরকে এখনি কতল করে ফেলবে আর তোমাদের পরিণামও খুব ভয়াবহ হবে।

যখন বড় বড় সর্দারেরা নিজ নিজ আপন জনদেরকে বুঝাতে ও পরামর্শ দিতে লাগলো, তখন লোকেরা অবরোধ ছেড়ে দিয়ে নীরবে চলে যেতে লাগলো। দশ-বিশজন করে এদিক-ওদিক থেকে লোক চলে যেতে লাগলো। হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি চল্লিশ হাজার লোক নিয়ে গভর্নর ভবন ঘেরাও করেছিলেন কিন্তু আসরের পর মাগরিবের আগে মাত্র পাঁচশ জন লোক ছাড়া বাকী সব চলে গেল। এতে হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি খুবই মর্মাহত হলেন। তিনি ভাবলেন, চল্লিশ হাজার লোক থেকে সাড়ে ঊনচল্লিশ হাজার চলে গেছে, কেবল পাঁচশ জন রয়ে গেল, তাদের উপরও বা কতটুকু আস্থা রাখা যায়? হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি যখন এ অবস্থা দেখলেন, তখন যে পাঁচশ জন ছিল, তিনি তাদেরকে বললেন, চলুন আমরা জামে মসজিদে গিয়ে মাগরিবের নামায আদায় করি। নামাযের পর পরামর্শ করব- কি করা যায়? সবাই বললেন, ঠিক আছে। হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি পাঁচশ লোককে নিয়ে মসজিদে গেলেন। তখন নামাযের সময় হয়ে গেছে। আযান হয়েছে। হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি সামনে দাঁড়িয়ে গেলেন। পাঁচশ জন পিছনে ইক্তিদা করলো। হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি তিন রাকায়াত ফরয নামায পড়ার পর যখন সালাম ফিরালেন, তখন দেখলেন, ঐ পাঁচশ জনের মধ্যে একজনও নেই।

আশ্চর্য! সকালে চল্লিশ হাজার লোক সাথে ছিল, এখন মাগরিবের পরে একজনও নেই! এরা তারাই, যারা নিজেদেরকে আহ্লে বাইত-এর একান্ত ভক্ত বলে দাবি করতো, যাদের পূর্ব পুরুষেরা আহ্লে বাইত-এর অনুসারী দাবীদার ছিল। এরাই চিঠি লিখেছিল, এরাই হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালামকে কূফায় আসার জন্য আহবান জানিয়েছিল, এরাই জান-মাল কুরবানীর জন্য নিশ্চয়তা দিয়েছিল! এরাই হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেছিল এবং বড় বড় শপথ করে ওয়াদা করেছিল যে, তারা জান দেবে তবুও তাঁর সঙ্গ ত্যাগ করবে না। কিন্তু তাদের প্রাণও দিতে হলো না, তীর দ্বারা আহতও হতে হলো না, না তরবারি দ্বারা আঘাত প্রাপ্ত হলো, কেবল ইবনে জিয়াদের ধমকেই হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর সঙ্গ ছেড়ে দিল এবং বিশ্বাসঘাতকতা করলো!

হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি নামায শেষে আল্লাহ পাককে স্মরণ করছিলেন এবং মনে মনে ভাবছিলেন, এখন কী করা যায়? সব লোকতো আমাকে ছেড়ে চলে গেল। আর এদিকে আমিতো হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালামকে চিঠি লিখে দিয়েছি যে, এখানকার অবস্থা খুবই সন্তোষজনক। এখানকার লোকদের মনে তাঁর প্রতি আন্তরিক ও অসীম মুহব্বত রয়েছে। চিঠি পাওয়ার পর হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম এক মুহূর্তও বিলম্ব করবেন না। তিনি খুব তাড়াতাড়ি এসে যাবেন। তখন কী যে প্রতিক্রিয়া হবে, যখন এসে দেখবেন এসব লোকেরা আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। এসব চিন্তা-ভাবনা নিয়ে তিনি মসজিদ থেকে বের হয়ে নিজ মুরীদের কাছে গেলেন। কিন্তু যেই মুরীদের কাছেই গেলেন, দেখলেন যে, ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। ডাকাডাকি করার পরও ঘরের দরজা খুলছে না। অথচ এরাই ঐসব লোক, যারা বড় বড় ওয়াদা করেছিল এবং আহ্লে বাইত-এর ভক্ত বলে দাবি করেছিল, এখন তারা ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে রাখলো!

হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি রাত্রে কুফার রাস্তায় এমনভাবে অসহায় অবস্থায় ঘুরে বেড়াতে লাগলেন যেমন একজন সহায়-সম্বলহীন মুছাফির ঘুরাফিরা করে। তিনি বড় পেরেশানীর সাথে অলি-গলিতে হাঁটতে লাগলেন। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে এক জায়গায় গিয়ে এক বৃদ্ধা মহিলাকে দেখলেন, যিনি ঘরের দরজা খুলে বসেছিলেন। তিনি তার কাছে গিয়ে পানি চাইলেন। বৃদ্ধা পানি দিলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কে? কোথা থেকে এসেছেন, কার সঙ্গে দেখা করবেন এবং কোথায় যাবেন? যখন বৃদ্ধা মহিলাটি তাঁর অবস্থা জিজ্ঞাসা করলেন, তখন তিনি অকপটে বললেন, ওহে বোন! আমি মুসলিম বিন আক্বীল, হযরত ইমাম হুসাইন বিন আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার প্রতিনিধি হয়ে কূফায় এসেছিলাম। মহিলাটি আশ্চর্য হয়ে বললেন, আপনি মুসলিম বিন আক্বীল রহমতুল্লাহি আলাইহি! আপনি এভাবে অসহায়ভাবে ঘুরাফিরা করছেন! কূফার সবাই জানে যে, আপনার হাতে হাজার হাজার লোক বাইয়াত হয়েছে এবং সবাই আপনার জন্য জান-মাল কুরবান করতে প্রস্তুত। কিন্তু এখন আমি কী দেখছি! আপনি যে এভাবে অসহায়, একাকী ঘুরাফিরা করছেন? হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, ‘হ্যাঁ বোন’! বাস্তবিকই তা ছিল। কিন্তু তারা আমার সাথে বেঈমানী করেছে। তাই আপনি আমাকে এই অবস্থায় দেখছেন। কূফার কোন ঘরের দরজা আজ আমার জন্য খোলা নেই, এমন কোন জায়গা নেই যেখানে আমি রাত্রি যাপন করতে পারি এবং আশ্রয় নিতে পারি। বৃদ্ধা মহিলা বললেন, আমার গরীবালয় আপনার জন্য খোলা আছে। আমার জন্য এর থেকে বড় সৌভাগ্য আর কি হতে পারে যে, রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার একজন আওলাদ আমার ঘরে মেহমান হয়েছেন। সেই বৃদ্ধাটি উনাকে ঘরে জায়গা দিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি তার ঘরে আশ্রয় নিলেন। সেখানে তিনি রাত যাপন করলেন।

খোদা তায়ালার কুদরত! ঐ বৃদ্ধার এক ছেলে ছিল বড় নাফরমান। এটা খোদা তায়ালারই শান যে, নেককার থেকে বদকার এবং বদকার থেকে নেককার পয়দা হয়। আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের ঘরে কাফির সৃষ্টি করে দেন এবং কাফিরদের ঘরে মুমিন। ফিরআউনের স্ত্রী শ্রেষ্ঠ ঈমানদার। আর হযরত লূত আলাইহিস সালাম-এর স্ত্রী হয়ে যায় কাফির। কাফিরের ঘরে লালিত-পালিত হয়ে যান নবী-রসূল। আর হযরত নূহ আলাইহিস সালাম-এর ঘরে জন্ম ও লালিত-পালিত কেনান হয়ে যায় কাফির। বৃদ্ধা মহিলার ক্ষেত্রেও তাই। তিনি নেককার। কিন্তু তার ঘরেই জন্ম নিয়েছে এক বড় নাফরমান।

শেষ রাতে বৃদ্ধার সেই নাফরমান ছেলে ঘরে আসলো, এসে মাকে পেরেশান দেখে জিজ্ঞাসা করলো, মা তুমি চিন্তিত কেন? মা বললেন, বৎস! মুসলিম বিন আক্বীল রহমতুল্লাহি আলাইহি, যিনি আমাদের প্রিয় নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খানদানের একজন। তিনি কূফায় এসেছিলেন হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার প্রতিনিধি হয়ে। কূফাবাসী তাঁর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেছিল। তারা তাঁর পিছে-পিছে থাকতো এবং জান-মাল কুরবানী করার নিশ্চয়তা দিয়েছিল। কিন্তু বর্তমান গভর্নরের ধমকীতে সবাই তাঁর সঙ্গ ত্যাগ করেছে এবং বেঈমানী করে সবাই তাঁর জন্য ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। তিনি অসহায় অবস্থায় অলি-গলিতে ঘুরছিলেন। যাক, খোদা তায়ালা আমাকে সৌভাগ্যবান করেছেন, আজ তিনি আমার ঘরে মেহমান এবং আমার ঘরে অবস্থান করছেন। তিনি আমার গরীবালয়ে ক্বদম রেখেছেন। এর জন্য আমি আজ গর্ববোধ করছি যে, আমি তাঁর মেহমানদারীর সুযোগ লাভ করলাম। এ জন্যই একদিকে আজ আমি খুবই আনন্দিত, আর অন্যদিকে আমি খুবই দুঃখিত যে, কূফাবাসীরা একজন সম্মানিত মেহমানের সাথে এ ধরনের বেঈমানী করতে পারলো।

বৃদ্ধা মহিলাটি যখন এসব ঘটনা বলছিলেন, তাঁর সেই নাফরমান ছেলে মনে মনে খুবই খুশি হলো এবং মনে মনে বলতে লাগলো- শিকার হাতের মুঠোয়, এটাতো বড় সৌভাগ্যের বিষয়। নাঊযুবিল্লাহ! আমার মাতো একজন সাধা-সিধে মহিলা। তিনি কি জানেন ইবনে জিয়াদের ঘোষণার কথা? ইবনে যিয়াদ তো ঘোষণা করেছে, যে ব্যক্তি হযরত মুসলিম বিন আক্বীল রহমতুল্লাহি আলাইহিকে গ্রেফতার করতে পারবে, তাকে এক হাজার দিরহাম পুরস্কার দেয়া হবে। যা হোক, তিনি যখন সৌভাগ্যবশতঃ আমার ঘরে এসে গেছেন, আমি খুবই সকালে গিয়ে খবর দিয়ে উনাকে আমার ঘর থেকে গ্রেফতার করাবো এবং হাজার দিরহাম পুরস্কার লাভ করবো। ছেলে এই অসৎ উদ্দেশ্য ও ইচ্ছা তার মার কাছে গোপন রাখলো।

এদিকে সে অস্থির হয়ে পড়লো, কখন সকাল হবে, কখন খবর পৌঁছাবে এবং পুরস্কার লাভ করবে। ফজর হওয়া মাত্রই সে তার অন্যান্য বন্ধুদের নিয়ে ইবনে যিয়াদকে খবর দিলো যে, হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি ওর ঘরেই অবস্থান করছেন, সে হলো সংবাদদাতা এবং সেই পুরস্কারের দাবিদার। ইবনে যিয়াদ বললো, তোমার পুরস্কার তুমি নিশ্চয়ই পাবে, প্রথমে উনাকে গ্রেফতার করার ব্যবস্থা করো। সে বললো, ঠিক আছে, আমার সাথে সিপাই পাঠিয়ে দিনতার কথা মতো তার সাথে সত্তরজন সিপাই গেল এবং সেই মহিলাটির ঘর চারদিক থেকে ঘেরাও করে ফেললো।

হযরত মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি এই অবস্থা দেখে তলোয়ার নিয়ে বের হলে সিপাইরা জঘন্যভাবে বেয়াদবী করলো এবং এমন ভাষা উচ্চারণ করলো, যা মোটেই বরদাশত্্যোগ্য নয়। ওরা হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার কঠোর সমালোচনা করলো এবং ইয়াযীদের প্রশংসা করলো। আর তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অভিযোগ আনলো। হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি এর যথার্থ উত্তর দিলেন। কিন্তু ইত্যবসরে ওরা তীর নিক্ষেপ করলো।
হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, যদি আলোচনা করতে চাও তাহলে বুদ্ধিমত্তার সাথে আলোচনা করো। আর যদি তীর নিক্ষেপ করো আমিও এর যথোচিত জবাব দিব। ওরা বললো, ঠিক আছে, শক্তি থাকলে জবাব দিন। তাদের কথা শুনে হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি তাদের সামনা-সামনি এসে গেলেন এবং তলোয়ার চালাতে শুরু করলেন। তিনি একাই সত্তরজনের সাথে মোকাবিলা করতে লাগলেন আর এদিকে ওরা তাঁর বীরত্বপূর্ণ আক্রমণে হতভম্ভ হয়ে গেল এবং তারা মনে মনে বললো, আমরা ধরাকে সরা জ্ঞান করে ভুল করলাম। হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর সুনিপূণ তলোয়ার চালনার সামনে ওরা টিকতে না পেরে পিছপা হলো। তবুও তিনি কয়েক জনকে হত্যা করতে সক্ষম হলেন এবং অনেককে আহত করলেন। এই অবস্থায় তিনি নিজেও আহত হলেন। একটা তীরের আঘাতে উনার সামনের দাঁত ভেঙ্গে গেল। রক্ত বের হচ্ছিল।

তখন তিনি বৃদ্ধা মহিলাটির কাছ থেকে পানি চাইলেন। মহিলাটি উনাকে পান করার জন্য এক পেয়ালা পানি দিলেন। যখন তিনি পানি পান করতে মুখে নিলেন, তখন সেই পানি মুখের রক্তে লালে লাল হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত তিনি পানি পান করলেন না। পেয়ালাটা মাটিতে রেখে তিনি মনে মনে বললেন, "হয়তঃ দুনিয়ার পানি আমার ভাগ্যে আর নেই। আমি জান্নাতুল ফিরদাউস-এ গিয়ে তৃষ্ণা নিবারণ করবো।"