নোটিশ

শুক্রবার, ২০ জানুয়ারী, ২০১২

কারবালার হৃদয় বিদারক ইতিহাস (৭)


ইমাম পরিবারকে অবরোধ ও ফোরাত নদীর পানি পান করতে বাধা

হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম যখন ইয়াযীদ বাহিনীকে সরাসরি জানিয়ে দিলেন যে, তোমাদের পক্ষ থেকে যে ব্যবস্থাই তোমরা নেও না কেন আমি কিছুতেই ইয়াযীদের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করবো না। তখন ইয়াযীদ বাহিনীর মনোভাব এত জঘন্য রূপ ধারণ করল যে, তারা হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম ও উনার প্রিয়জনদের জন্য ফোরাত নদীর পানি বন্ধ করে দিল। সেদিন ছিল ৭ই মুর্হরম ৬১ হিজরী। ইয়াযীদ বাহিনী প্রায় চার হাজার সৈন্য ফোরাত নদীর তীরে নিয়োজিত করলো। এদের মধ্যে দুই হাজার ছিল স্থল বাহিনীআর দুই হাজার ছিল অশ্বারোহী
তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল উনাদেরকে যেন এক ফোঁটা পানিও নিতে দেয়া না হয়। সে নির্দেশ অনুযায়ী উনাদের জন্য তারা পানি বন্ধ করে দিল। হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার বিরাশিজন সঙ্গী সাথীর মধ্যে দুগ্ধপোষ্য শিশু ছিলেন এবং পর্দানশীন মহিলারাও ছিলেন। তিনি শুনে আরও আশ্চর্য হয়ে গেলেন যে, উনাদের মোকাবিলা করার জন্য বাইশ হাজার সৈন্য এসেছে। কী আশ্চর্য! বিরাশিজনের মোকাবিলায় বাইশ হাজার সৈন্য! আবার এই বিরাশিজনের মধ্যে শিশু ও মহিলারা রয়েছেন। অথচ উনাদের মোকাবিলায় যে বাইশ হাজার সৈন্য তারা সবাই যুবক এবং তারা সকল প্রকারের অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে এসেছে। এরপরও তারা পানি বন্ধ করে দিল। কারণ, তাদের ধারণা হল যে, উনারা যদি পানি পান করে যুদ্ধ করেন, তাহলে সম্ভবতঃ আমরা বাইশ হাজার হয়েও কামিয়াব হতে পারবো না। তাই পানি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এটা জুলুমের উপর জুলুম ছিল।

আফসুস! ঐসব যালিমদের জন্য, যারা এমন এক মহান ব্যক্তি এবং উনার পরিবার-প্রিয়জনদের জন্যে পানি বন্ধ করে দিল, যিনি হচ্ছেন সাকিয়ে কাওছার, শাফিয়ে মাহ্শার হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আদরের দৌহিত্র হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম।

ঐ কুখ্যাত ইয়াযীদ বাহিনীর প্রধান নির্দেশ দিয়েছিল যে, "মানুষ, জীব-জন্তু, বিধর্মী, গরু-ছাগল, পশু-পাখি সবাই এই ফোরাত নদীর পানি পান করবে, তোমরা বাধা দিও না। কিন্তু হযরত ফাতিমাতুয্ যাহরা আলাইহাস সালাম-এর এই ছেলে হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালামকে পানি পান করতে দিও না।" যেই ফোরাত নদীর পানি সবারই পান করার অনুমতি ছিল, জীব-জন্তু, পশু-পাখি কারো জন্য বাধা ছিল না। কিন্তু সেই ফোরাত নদীরপানি পান করা থেকে বাধা দিল সাকিয়ে কাওছার, শাফিয়ে মাহ্শার হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রিয় দৌহিত্র হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালামকে।







হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম আনহু উনার আহবান

হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম যখন দেখলেন যে, পানিও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, তখন তিনি ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে ইয়াযীদের সৈন্য বাহিনীর নিকট গেলেন এবং তাদের সামনে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখলেন। তিনি তাদেরকে একান্ত যুক্তির মাধ্যমে বুঝালেন, ‘জুলুম-অত্যাচার থেকে বিরত থাকো, রক্ত দ্বারা তোমাদের হাতকে রঞ্জিত করো না। জেনে শুনে কোন মুমিনকে কতল বা শহীদ করা মানে জাহান্নামকে নিজের ঠিকানায় পরিণত করা। আমি হলাম তোমাদের রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার দৌহিত্র। যে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনারই তোমরা কলেমা পড়ো। আর বর্তমানে আমি ছাড়া তোমাদের রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার অন্য কোন দৌহিত্র নেই। আর আমার সম্পর্কে তোমরা ভালভাবে জানো, আমি ঐ হুসাইন, যার সম্পর্কে রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন- "হযরত ইমাম হাসান ও হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালামমা বেহেশ্তের যুবকদের সাইয়্যিদ।" আমি সেই হুসাইন, যখন নিজ মায়ের কোলে ক্রন্দন করতাম, তখন আল্লাহ তায়ালার প্রিয় রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন, "ওগো মা ফাতিমা! ওকে কাঁদায়োনা। কারণ ও কাঁদলে আমার খুবই কষ্ট হয়।" দেখ, যখন আপন মায়ের কোলে আমার কান্নাটা নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার জন্য কষ্টদায়ক ছিল, এখন তোমরা যদি আমাকে ভিন দেশে কষ্ট দাও এবং আমার রক্ত দ্বারা তোমাদের হাতকে রঞ্জিত করো, আমার ছেলে মেয়েদেরকে শোকাভিভূত করো, তাহলে চিন্তা করে দেখ, নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কী কষ্ট পাবেন! আর যে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে কষ্ট দিবে, এর পরিণাম সম্পর্কে তোমরা পবিত্র কুরআন শরীফ-এই পড়েছো-
ان الذين يؤذون الله ورسوله لعنهم الله فى الدنيا والاخرة واعد لهم عذابا مهينا
অর্থ: নিশ্চয়ই যারা আল্লাহ পাক ও তাঁর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে কষ্ট দেয়, তাদের প্রতি দুনিয়া ও আখিরাতে আল্লাহ পাক উনার লানত এবং আল্লাহ পাক তাদের জন্য অত্যন্ত কষ্টদায়ক শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছেন। (সূরা আহযাব-৫৭)

যখন তিনি নিজের এ বক্তব্য অকাট্য যুক্তির মাধ্যমে বুঝালেন যে, জুলুম-অত্যাচার থেকে বিরত থাকো এবং আমার রক্ত দ্বারা তোমাদের হাত রঞ্জিত করো না। আমি তোমাদের কোন ক্ষতি করিনি, তোমাদের সন্তানাদি হত্যা করিনি, তোমাদের প্রতি কোন অত্যাচার করিনি। আমিতো কূফাবাসীর আহবানে এসেছি। তারা যখন বিশ্বাসঘাতকতা করলো তখন আমাকে চলে যেতে দাও। কিন্তু তাদের মনে অসৎ মনোভাব প্রাধান্য বিস্তার করেছিল, তাদের কপালে জাহান্নাম অবধারিত ছিল। তাই হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার আহবান তাদের মনে কোন রেখাপাত করলো না। বরং তারা হৈ-চৈ শুরু করে দিল এবং বলতে লাগলো, আমরা আপনার বক্তৃতা শুনতে আসিনি। হয় ইয়াযীদের বাইয়াত গ্রহণ করুন অথবা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হোন। তিনি বললেন, আমি আমার পক্ষে যা প্রমাণ করার ছিল তা প্রমাণ করলাম। যেন কাল কিয়ামতের মাঠে তোমাদের এ কথাটুকু বলার সুযোগ না থাকে, হে আল্লাহ পাক! আমাদের জানা ছিল না, আমাদেরকে কেউ বুঝায়নি, তখন আর তোমরা আল্লাহ তায়ালার দরবারে এ ধরনের কোন আপত্তি পেশ করতে পারবে না। এখন সেটা প্রমাণিত হয়ে গেছে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ ফরমান-
وما كنا معذبين حتى نبعث رسولا
অর্থ: কোন রসূল অর্থাৎ হিদায়েতকারী না পাঠানো পর্যন্ত আমি কাউকে শাস্তি দান করবো না। (সূরা বণী ইসরাইল-১৫)
অতএব, যা প্রমাণ করার ছিল তা প্রমাণিত হয়ে গেছে। এখন তোমাদের যা ইচ্ছা তা করো।

মুহররমের নয় তারিখ ইয়াযীদ বাহিনীর মধ্যে আনন্দ-উল্লাস শুরু হয়ে গেল। এটা পূর্ণ যুদ্ধ ঘোষণার পূর্বাভাস ছিল। হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম তাঁর এক সঙ্গীকে ওদের কাছে পাঠালেন এবং বললেন, ওদেরকে গিয়ে বলুন, আমাদেরকে যেন একরাত্রি সময় দেয়। ইয়াযীদ বাহিনী এই কথাটি গ্রহণ করলো এবং এক রাত্রির সুযোগ দিলো।