নোটিশ

শুক্রবার, ২০ জানুয়ারী, ২০১২

কারবালার হৃদয় বিদারক ইতিহাস (৮)


কারবালার ঐতিহাসিক ১০ই মুহররম

হিজরী ৬১ সন, মুর্হ্রম মাসের ৯ তারিখ দিবাগত রাত অর্থাৎ দশ তারিখ রাত্রি বেলা হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার সফর সঙ্গীদের সবাইকে একত্রিত করলেন এবং বললেন, আমার প্রিয় সাথীরা! আমি তোমাদের সকলের প্রতি আন্তরিকভাবে সন্তুষ্ট। আমি তোমাদেরকে অনুমতি দিচ্ছি যে, আজ রাতে তোমরা যে যেদিকে পার চলে যাও। এইসব ইয়াযীদী বাহিনীর লোকেরা আমার রক্ত পিপাসু। এরা একমাত্র আমার রক্তেই পরিতৃপ্ত হবে। তোমরা চলে যাও, তোমাদের জান বেঁচে যাবে। কিন্তু উনার সাথীদের মধ্যে একজনও যেতে রাজী হলেন না।
তাঁরা বললেন, এ নাজুক সময়ে আপনাকে শত্রুদের হাতে সোপর্দ করে আমরা কিভাবে চলে যেতে পারি! এ রকম পরিস্থিতিতে যদি আপনাকে ফেলে আমরা চলে যাই, কাল ক্বিয়ামতের মাঠে আমরা আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে কিভাবে মুখ দেখাব? না! কিছুতেই আমরা আপনাকে ফেলে চলে যেতে পারি না। আমরা আপনার সাথেই থাকবো এবং আমরা আমাদের জানকে পতঙ্গের মতো উৎসর্গ করবো।

যখন কেউই যেতে রাজি হলেন না, তখন হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম বললেন, তাহলে শুন! যদি তোমরা আমার সাথে থাকার জন্য দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হও, তাহলে তোমরা ধৈর্য এবং আত্ম-বিশ্বাসে শিশাঢালা প্রাচীরের মতো অটল হয়ে যাও। এমন দৃঢ় ও অটল হয়ে যাও, যেন জুলুম-অত্যাচারের বিভীষিকা তোমাদের পদস্খলন ঘটাতে না পারে। বাতিলের সাথে মোকাবিলা করার সময়টা হলো, আমাদের পরীক্ষার সময়। আল্লাহ তায়ালা উনার বান্দাদের থেকে পরীক্ষা নিয়ে থাকেন। এখন আমাদের সামনে মুছীবতের পাহাড় অবস্থিত। সমস্ত দুঃখ-দূর্দশা আমাদেরকে ধৈর্য সহকারে অতিক্রম করতে হবে। আল্লাহ তায়ালার রাস্তায় অটল থাকতে হবে এবং এভাবে অটল থেকে শাহাদাতের শরবত পান করতে হবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য উদাহরণ রেখে যেতে হবে। হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার এ কথা উনার সাথীদের মধ্যে যথেষ্ট ধৈর্য ক্ষমতা সৃষ্টি করে দিলো। উনার সকল সাথী উনার জন্য জান কুরবান করতে প্রস্তুত হয়ে গেলেন এবং সকলেই শাহাদাত বরণের জন্য অনুপ্রাণিত হয়ে গেলেন এবং ধৈর্য ও ত্যাগ স্বীকারের জন্য দৃঢ় পাহাড় বনে গেলেন। হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম বললেন, তোমরা কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম করো। সকাল বেলা আল্লাহ পাক উনার হুকুম যা হওয়ার তাই হবে।

হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার সাথীরা সবাই নিজ নিজ তাঁবুতে চলে গেলেন এবং তিনি নিজের তাঁবুতে কুরআন শরীফ তিলাওয়াত শুরু করলেন। কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করতে করতে তন্দ্রাভাব আসায় তিনি কিছুক্ষণের জন্য শুয়ে পড়লেন। তখন স্বপ্নে দেখলেন, তাঁর নানাজান ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাশরীফ এনেছেন এবং উনাকে কোলে নিয়ে নিলেন এবং তাঁর বুকে হাত মুবারক রেখে বললেন- اللهم ات الحسين صبرا واجرا আল্লাহুম্মা আতিল হুসাইনা ছব্্রাওঁ ওয়া আজ্রাঅর্থাৎ হে আল্লাহ পাক! হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে ধৈর্য ও পূণ্য দান করুনএবং হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে আরও বললেন, ‘তোমার উপর যা হচ্ছে, তা থেকে আমি বেখবর নই। আমি সবকিছু দেখছি। তোমার বিরুদ্ধে যারা তলোয়ার, তীর ইত্যাদি নিয়ে এসেছে, তারা সকলেই আমার শাফায়াত থেকে বঞ্চিত।নূরে মুজাস্সাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এটা বলে ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার অন্তরকে ধৈর্য এবং স্থিরতার খনি বানিয়ে দিলেন। হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম ঘুম থেকে উঠে উনার বন্ধু-বান্ধব এবং পরিবার পরিজনকে স্বপ্নের কথা শুনালেন। ফজরের নামাযের পর তিনি আল্লাহ পাক উনার কাছে প্রার্থনা করছিলেন- ইয়া আল্লাহ! আপনার রাস্তায় আমাকে অটল রাখুন, আমাকে ধৈর্য এবং সহনশীলতা দান করুন। হে মাওলা! জুলুম-অত্যাচারের ঝড় তুফান আমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে, আপনি আমাকে অটল থাকার তাওফীক দান করুন, যেন জুলুম-অত্যাচার আমাকে পদচ্যুত করতে না পারে।এভাবে তিনি মুনাজাত করছিলেন আর উনার সাথীরা আমীন, আমীন বলছিলেন।

মোটকথা, একদিকে পিপাসাকাতর আল্লাহ তায়ালার নেক বান্দাগণ ধৈর্য এবং সহনশীলতার জন্য আল্লাহ পাক উনার কাছে প্রার্থনা করছেন, অন্যদিকে ইয়াযীদের সৈন্যদের মধ্যে যুদ্ধের মহড়া চলছে। দুর্যোগের কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে গেল, ইয়াযীদের সৈন্যরা লম্ফ-ঝম্ফ দিতে লাগল, তাদের মধ্যে কতেক জাহান্নামী কুলাঙ্গার ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার তাঁবুর আশে-পাশে চক্কর দিতে লাগল এবং গর্ব ও অহংকারভরে হুঙ্কার দিয়ে বলতে লাগল, এমন কোন বাহাদুর আছ? থাকলে আমাদের মোকাবিলায় আস। ইত্যবসরে যালিমদের মধ্যে কেউ হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার তাঁবুর দিকে তীর নিক্ষেপ করল এবং মোকাবিলার জন্য হুঙ্কার দিল।







হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার অনুসারীদের শাহাদাত

হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার সাথীদের মধ্যে যারা শাহাদাত বরণ করার জন্য উদগ্রীব ছিলেন, তাঁরা মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলেন এবং হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার অনুমতি প্রার্থনা করলেন। হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম তাঁদেরকে অনুমতি দিলেন। অনুমতি পেয়ে হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার সঙ্গীরা জিহাদের ময়দানে বীরত্ব প্রদর্শন করতে লাগলেন। তিন দিনের পিপাসাকাতর জানবাজ মর্দে মুজাহিদগণ ক্ষুধা এবং ধৈর্যের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করছিলেন। কিন্তু ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত হলে কি হবে, হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার সাথীরা ছিলেন ঈমানী বলে বলীয়ান। তাঁর এক একজন সঙ্গী ইয়াযীদী বাহিনীর দশজনের থেকেও অধিক শক্তিশালী ছিলেন। প্রচ- জিহাদ শুরু হয়ে গেল এবং হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার সাথীরা অনেক ইয়াযীদী বাহিনীকে জাহান্নামে পাঠিয়ে শেষ পর্যন্ত নিজেরা এক এক করে শাহাদাত বরণ করেন। হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম নিজের চোখের সামনে তাঁর পঞ্চাশজন সাথীর শাহাদাত বরণ দেখলেন। এত কিছু দেখার পরও তিনি সামান্য ধৈর্যচ্যুত হননি; বরং তিনি সঙ্গী-সাথীদের বুকে তীর নিক্ষেপ অবলোকন করছিলেন আর বলছিলেন- رضيت بقضائك রদ্বীতু বিক্বদ্বায়িকাঅর্থাৎ মাওলা! আমি আপনার ইচ্ছা এবং আপনার সিদ্ধান্তের উপর সন্তুষ্ট।
পঞ্চাশজন সাথী শহীদ হওয়ার পর হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার মুষ্ঠিমেয় আপনজন ছাড়া আর কেউই রইলো না।