নোটিশ

শুক্রবার, ২০ জানুয়ারী, ২০১২

কারবালার হৃদয় বিদারক ইতিহাস (১০)


হযরত আব্দুল্লাহ বিন হাসান রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর শাহাদাত

হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার সামনে তাঁর আপন ভাতিজা, হযরত ইমাম হাসান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার নয়নের মণি এবং হযরত ফাতিমাতুয্ যাহরা আলাইহাস সালাম ও হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু আলাইহিস সালাম উনার দৌহিত্র উপস্থিত হলেন। তিনি জিহাদে গমনের জন্য অনুমতি প্রার্থনা করলেন।
তিনি যখন অনুমতি প্রার্থনা করলেন তখন হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার ভাতিজার প্রতি অশ্রুসজল নয়নে তাকালেন এবং বললেন, ‘তোমরা আমার সাথে এসেছিলে, চাচার সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় উনার ভক্ত ও মুরীদানদের বাড়িতে যাবে এবং কিছুদিন আনন্দ-ইত্মিনানে দিন অতিবাহিত করবে। আর আমিও তোমাদেরকে তলোয়ার ও তীরের আঘাত খাওয়ার জন্য সঙ্গে আনিনি। শোন! ওরা আমার রক্তের পিপাসু, তোমাদের রক্তের জন্য লালায়িত নয়। সুতরাং, তোমাকে আমি অনুমতি দিতে পারিনা। তুমি আশ্রয় শিবিরে চলে যাও এবং তোমার মা-বোনদের সাথে মদীনা মুনাওওয়ারায় চলে যেও। কিন্তু ভাতিজা বার বার বলতে লাগলেন, চাচাজান! আমাকে আপনার হাতে বিদায় দিন এবং আপনার বর্তমানেই জিহাদের ময়দানে যাওয়ার অনুমতি দিন। আমিও জান্নাতুল ফিরদাউসে পৌঁছার জন্য অস্থির। চাচাজান! দীর্ঘ তিন দিনের পিপাসায় খুবই কষ্ট পেয়েছি। এখন মন চাচ্ছে যে, যত তাড়াতাড়ি পারি জান্নাতুল ফিরদাউসে পৌঁছে আপন পিতা ও দাদাজানের হাত মুবারকে কাওছারের পানি পান করে তৃষ্ণা নিবারণ করি। ভাতিজার জান-কুরবানীর জন্য এ রকম দৃঢ় সংকল্প বোধ দেখে উনাকে ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু নিজের বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরলেন; এরপর অশ্রুসজল নয়নে অনুমতি দিলেন।


হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু আলাইহিস সালাম উনার দৌহিত্র, হযরত ইমাম হাসান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার নয়নমণি হযরত আব্দুল্লাহ বিন হাসান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু কারবালার মাঠে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মত চমকাতে লাগলেন এবং ইয়াযীদী বাহিনীর সাথে মোকাবিলা করে অনেক ইয়াযীদী সৈন্যকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করে নিজে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে শেষ পর্যন্ত শাহাদাত বরণ করেন।









হযরত ইমাম ক্বাসিম রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর শাহাদাত

এবার হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার সামনে যিনি এসে উপস্থিত, উনি হলেন উনার প্রিয় ভাতিজা হযরত ক্বাসিম রহমতুল্লাহি আলাইহি। যাঁর সাথে উনার মেয়ে হযরত সখিনা আলাইহাস সালাম উনার বিবাহের আগাম ওয়াদা ছিল। হযরত ক্বাসিম রহমতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন ঊনিশ বছরের নওজোয়ান। যখন উনি উনার নওজোয়ান ভাতিজাকে সামনে দেখলেন, তখন তিনি কেঁদে ফেললেন এবং বললেন, বাবা! আমি তোমাকে কিভাবে বিদায় দিতে পারি? তোমাকে কি আমি তীর-তলোয়ারের আঘাত খাওয়ার অনুমতি দিতে পারি? প্রিয় ভাতিজা! দেখ, আমার ভাইয়ের এটা একান্ত আশা ছিল যে, সখিনার বিবাহ যেন তোমার সাথে হয়। শোন ভাতিজা! তুমি মদীনা মুনাওওয়ারায় ফিরে গিয়ে আমার মেয়ে সখিনার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আমার ভাইয়ের আশা পূর্ণ করো। কিন্তু হযরত ক্বাসিম রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, চাচাজান! আমার আব্বাজানের আরও একটি আশা ছিল, সেটা হলো, আমার আব্বাজান আমার গলায় একটা তাবিজ দিয়েছিলেন এবং ওসীয়ত করে গিয়েছেন যে, ‘বাবা! এ তাবিজটা তখনই খুলে দেখো, যখন কোন বড় মুছীবতের সম্মুখীন হও এবং সেই মুতাবিক আমল করো।তাই আমি এ মুহূর্তে তাবিজটা খুলে দেখলাম। কারণ এর থেকে বড় মুছীবত আর কী হতে পারে! তাবিজ খুলে যা লিখা দেখলাম তাহলো- ওহে আমার প্রিয় বৎস ক্বাসিম! এমন এক সময় আসবে, যখন আমার ভাই কারবালার মাঠে শত্রু পরিবেষ্টিত হবে। শত্রুরা উনার জানের পিপাসু হবে, বৎস! তুমি যদি সত্যিকার আমার ছেলে হও, তখন নিজ জানের কোন পরওয়া করো না। বরং নিজের জান চাচার জন্য উৎসর্গ করে দিও। কারণ, সেই সময় আমার ভাই হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার জন্য যে জান কুরবানী দেবে, আল্লাহ তায়ালার দরবারে সে খুবই উচ্চ মর্যাদা লাভ করবে।তাই চাচাজান! আমাকেও আপনার হাতে বিদায় দিন। আমি আপনার পরে জীবিত থাকতে চাই না। আমাকে বিদায় দিন, আমি যাতে সহসা জান্নাতুল ফিরদাউসে পৌঁছে তৃষ্ণা নিবারণ করতে পারি এবং আব্বাজানকে গিয়ে বলতে পারি, আব্বাজান! আমি আপনার ওসীয়ত পূর্ণ করে এসেছি।

হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম শেষ পর্যন্ত উনাকেও বুকে জড়িয়ে ধরে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে বিদায় দিলেন। হযরত ইমাম ক্বাসিম রহমতুল্লাহি আলাইহি ইয়াযীদী বাহিনীর বড় বড় যোদ্ধাকে টুকরো-টুকরো করে ফেলতে লাগলেন। ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত হওয়া সত্ত্বেও তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে যে বীরত্ব দেখান, তা দেখে ইয়াযীদী বাহিনীর জাদরেল সৈন্যরাও হতভম্ব হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত তিনিও আঘাতের পর আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে ঘোড়া থেকে পড়ে যান এবং জান্নাতুল ফিরদাউসে পৌঁছেন । এভাবেই হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার চারজন ভাতিজা শহীদ হন।










ভাগিনাদ্বয়ের শাহাদাত

চার ভাতিজার শাহাদাতের পর হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার আপন বোন হযরত যয়নাব আলাইহাস সালাম উনার দুই অবুঝ সন্তান হযরত মুহম্মদ এবং হযরত আউন রহমতুল্লাহি আলাইহিমাকে নিয়ে উনার সামনে উপস্থিত হয়ে বললেন, ভাইজান! আপনার এ ভাগিনাদ্বয়ও আপনার জন্য জান কুরবান করতে প্রস্তুত। হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম বললেন, বোন! এদেরকে তীরের আঘাত খাওয়ার জন্য সাথে আনা হয়নি। আমার সামনে তাঁদেরকে বর্শার অগ্রভাগে ঝুলানো হবে, তা আমার সহ্য হবে না। তুমি তাঁদেরকে নিয়ে যাও এবং আশ্রয় শিবিরে গিয়ে অবস্থান করো।বোন বললেন, ভাইজান! কখনো তা হতে পারে না, আমি চাই আমার সন্তানদ্বয় আপনার জন্য কুরবান হোক। আমি যেন জান্নাতুল ফিরদাউসে গিয়ে আমার আব্বাজানকে বলতে পারি, আমার দুটি ছেলেকেও আপনার সন্তানের জন্য কুরবানী দিয়েছি। তাই আপনি এদেরকে বুকে জড়িয়ে ধরুন এবং বিদায় দিন।

বোনের বার বার আকুতি-মিনতির কারণে উনি তাঁদেরকেও যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠালেন। হযরত যয়নাব আলাইহাস সালাম উনার নয়নমণি ও জানের জান সন্তানদের প্রতি নিজের অগাধ মায়া-মমতাকে বিসর্জন দিয়ে সন্তানদ্বয়কে বিদায় দিলেন। এ কঁচি ছেলেদ্বয় বেশি দূর অগ্রসর হতে পারলেন না। ইয়াযীদী বাহিনীর যালিমেরা এসে তাঁদেরকে বর্শার অগ্রভাগে উঠিয়ে নিল।

হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম এ দৃশ্য দেখে দৌঁড়ে গেলেন এবং ভাগিনাদ্বয়ের মুবারক লাশ কাঁধে নিয়ে আশ্রয় শিবিরের কাছে এনে রাখলেন এবং বোনকে সম্বোধন করে বললেন
, ওহে বোন! তোমার আরজু পূরণ হলো। তোমার সন্তানদ্বয় জান্নাতুল ফিরদাউসে পৌঁছে তৃষ্ণা নিবারণ করছে। মা শহীদ ছেলেদ্বয়ের পাশে দাঁড়িয়ে নীরবে চোখের পানি ফেললেন এবং ছেলেদের মাথার চুলে আঙ্গুল বুলিয়ে বুলিয়ে বললেন, বাবারা! তোমাদের প্রতি তোমাদের মা খুবই সন্তুষ্ট। তোমরা তোমাদের মামার জন্য জান-কুরবান করেছ এবং জান্নাতুল ফিরদাউসে পৌঁছে গেছ।