শহীদ পরিবার ও খন্ডিত মস্তক মুবারক দামেস্কে
প্রেরণ
এভাবে তিনদিন পর্যন্ত
মস্তকসমূহ ও শহীদ পরিবারের সদস্যগণকে ঘুরানোর পর ইবনে যিয়াদ নির্দেশ দিল, এবার এ মস্তকসমূহ ও শহীদ পরিবারের
সদস্যদেরকে দামেস্কে ইয়াযীদের কাছে নিয়ে যাও। ইবনে যিয়াদ আরো বলল যে, পথের মধ্যে কোন গ্রাম, বাজার, কোন লোক বসতি সামনে পড়লে যেন তাকবীর ইত্যাদি বলে শোরগোল করে
যাওয়া হয়, যাতে লোকেরা ভয় পায়
এবং ইয়াযীদের বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ করার সাহস না পায়।
অতঃপর ইয়াযীদী
বাহিনী মস্তক সমূহ বর্শায় বিদ্ধ করে এবং শহীদ পরিবারের সদস্যদেরকে উটের উপর
উঠিয়ে কূফা থেকে দামেস্কের পথে রওয়ানা দিল। চলতে চলতে রাত্রিবেলা এক গীর্জার
সন্নিকটে উপনীত হলো। যে সময় এ কাফেলা গীর্জার কাছে পৌঁছল, সে সময় গীর্জা থেকে এর প্রধান পাদ্রী
বের হয়ে ওদের সামনে এসে জিজ্ঞাসা করল, তোমরা
কে? কোথা থেকে আসতেছ?
এ মস্তকগুলো কাদের? এ মহিলাগণ কারা? তোমরা যাচ্ছ কোথায়? ঘটনা কি? তারা সম্পূর্ণ ঘটনা বর্ণনা করল। পাদ্রী সম্পূর্ণ ঘটনা শুনার পর
বলল, তোমরা চলতে চলতে
ক্লান্ত হয়ে পড়েছ, রাতটা
এখানেই কাটাও এবং এক রাতের জন্য হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার মস্তক
মুবারকটি আমার কাছে আমানত রাখ এবং এসব পুত-পবিত্র মহিলাগণ যারা আছেন উনাদের খিদমত
করারও আমাকে সুযোগ দাও। ওরা বলল, তা
কিছুতেই হতে পারে না। সরকারের গুরু দায়িত্ব আমাদের কাঁধে অর্পণ করা হয়েছে। এ
মস্তক আমরা কারো কাছে দিতে পারি না। মস্তক ও এদেরকে ইয়াযীদের কাছে পৌঁছাতে হবে।
পাদ্রী বলল, ঠিক আছে পৌঁছাবে,
কিন্তু এ রাত্রেতো আর পৌঁছাতে পারবে না।
ওরা বলল, আমরা এখানে রাত
অতিবাহিত করতে রাজী আছি। কিন্তু মস্তক দিতে রাজী নই। পাদ্রী বলল, আমার থেকে টাকা নিয়ে হলেও এক রাত্রের
জন্যে মস্তকটি আমার হিফাজতে দাও এবং আমি ওয়াদা করছি, তোমাদের মস্তক ফিরিয়ে দিব। ওরা বলল, আমাদেরকে কত টাকা দিবেন? পাদ্রী বলল, আমার
কাছে আমার সারা জীবনের উপার্জন আশি হাজার দিরহাম জমা রয়েছে। আমি সব তোমাদেরকে
দিয়ে দিব। তোমরা শুধু এক রাত্রের জন্যে মস্তকটি দাও। ওরা চিন্তা করল, ইয়াযীদ থেকে তো বখশিশ পাবই, আর এদিকে নগদ আশি হাজার দিরহাম হাতছাড়া
করবো কেন? শেষ পর্যন্ত তারা
রাজী হয়ে গেল এবং এক রাত্রের জন্যে হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার মস্তক
মুবারকটি উক্ত পাদ্রীকে দিয়ে দিল।
পাদ্রী গীর্জার এক
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কামরা আহলে বাইত-এর সম্মানিত সদস্যগণকে বিশ্রামের জন্য দিয়ে
দিল এবং উনাদের খিদমত করার জন্য কয়েকজন খাদিম নিয়োজিত করে তাদেরকে বলে দিল যেন
উনাদের কোন কষ্ট না হয়। আহলে বাইত-এর সদস্যগণ পাদ্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন, পাদ্রী সাহেব! আমাদের আগমনের খবর আপনি
কিভাবে জানতে পারলেন? পাদ্রী
বলল, আমি ভিতরে বসা ছিলাম,
তখন আপনাদের কাফেলা বেশ কিছু দূরে ছিল,
আমি হঠাৎ শুনলাম, আমার গীর্জার বড় দেয়ালটা কাঁদছে। আমি
আমার জীবনে এ রকম কান্না আরও কয়েকবার শুনেছি। কান্না শুনার পর আমি বুঝতে পারলাম,
কোন একটা অঘটন ঘটেছে। তখন আমি বের হলাম,
কি ঘটনা ঘটল তা দেখার জন্য। তখন আমি
আপনাদের কাফেলা দেখতে পেলাম। এবং সমস্ত ঘটনা শুনে বুঝতে পারলাম, আপনাদের প্রতি অমানুষিক জুলুম করা হয়েছে।
নবী মুস্তফা ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার দৌহিত্রকে নিদারুণ অত্যাচারের
সাথে শহীদ করা হয়েছে এ জন্যই বড় দেয়ালটা কাঁদছিল।
অতঃপর পাদ্রী
উনাদেরকে ধৈর্যধারণের কথা বললেন এবং বললেন, আল্লাহ তায়ালা’র
নেক বান্দাগণের প্রতি এরকম মুছিবত আগেও এসেছে, বর্তমানেও আসছে এবং ভবিষ্যতেও আসবে। আপনাদেরকে ধৈর্য ও
সহনশীলতার পরাকাষ্ঠা দেখাতে হবে। আল্লাহ তায়ালা আপনাদের নাম কিয়ামত পর্যন্ত চির
জাগরুক রাখবেন।
এরপর পাদ্রী ইয়াযীদ
বাহিনীকে আশি হাজার দিরহাম দিয়ে হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার মস্তক
মুবারক নিয়ে নিলেন। মস্তক মুবারক নিয়ে তিনি তার উপাসনালয়ে চলে গেলেন। চেহারা
মুবারকে যেসব রক্তের দাগ ছিল, তিনি
সব পরিষ্কার করলেন এবং নিজের কাছে যা সুগন্ধি ছিল সব হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস
সালাম উনার চুল ও দাড়ী মুবারকে ঢেলে দিলেন এবং একটি রেশমী কাপড়ে জড়িয়ে উঁচু
জায়গায় রাখলেন আর সারা রাত তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন ও কান্না-কাটি করলেন। তিনি হযরত
ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার মস্তক মুবারকের যথাসাধ্য যত্ন নিলেন এবং যথাযথ
সম্মান করলেন।
মহান আল্লাহ পাক উনার
রহমতের শান দেখুন, সকাল বেলা পাদ্রীর
মুখ থেকে কালিমা তাইয়্যিবাহ্ জারি হয়ে গেল। মস্তক মুবারকের তা’যীম করার ফলে আল্লাহ তায়ালা উনাকে
ঈমানী দৌলত দ্বারা পরিতুষ্ট করলেন এবং তিনি মুসলমান হয়ে গেলেন। তিনি দুনিয়াবী
দৌলত ত্যাগ করলেন, আল্লাহ তায়ালা উনাকে
ঈমানী দৌলত দান করলেন। তিনি অস্থায়ী দৌলত (আশি হাজার দিরহাম) ব্যয় করলেন,
আল্লাহ তায়ালা এর বিনিময়ে উনাকে
স্থায়ী দৌলত (ঈমান) দান করলেন।
সকালে ইয়াযীদী
বাহিনী পবিত্র মস্তকসমূহ ও শহীদ পরিবারের সদস্যগণকে নিয়ে
পুনরায় রওয়ানা দিল। কিছু দূর যাওয়ার
পর ইয়াযীদী বাহিনী পরস্পর শলা-পরামর্শ করে পাদ্রী প্রদত্ত আশি হাজার দিরহাম তাদের
মধ্যে বণ্টন করে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিল। কারণ, ইয়াযীদ জানতে পারলে সব দিরহাম নিয়ে নিতে পারে। সিদ্ধান্ত
মুতাবিক বণ্টন করার জন্য যেইমাত্র দিরহামের পুটলি খুলল, তখন দেখতে পেল সব মাটির পাত্রের ভাঙ্গা টুকরা এবং প্রতিটি
টুকরার দুই পিঠে পবিত্র কুরআন শরীফ-এর আয়াত শরীফ লিখা। এক পিঠে লিখা ছিল-
وسيعلم
الذين ظلموا اى منقلب ينقلبون
অর্থ: ‘যুুলুমকারীরা অতিসত্ত্বর জানতে পারবে,
তারা কোন দিক হয়ে বসে আছে।’ (সূরা শুয়ারা-২২৭)
অপর পিঠে লিখা ছিল- ولاتحسبن
الله غافلا عما يعمل الظالمون
অর্থ: ‘আল্লাহ তায়ালাকে যালিমের কাজকর্মের
প্রতি উদাসীন মনে করো না। যালিমরা যা কিছু করছে, আল্লাহ তায়ালা সব জানেন। এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালাকে বেখবর
মনে করো না।’ (সূরা ইবরাহীম-৪২)
দেখুন, আশি হাজার দিরহাম ওরা
নিয়েছিল, কিন্তু তা মাটির পাত্রের ভাঙ্গা টুকরা হয়ে গেল।
তারাতো দ্বীনের পরিবর্তে দুনিয়াকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল, সেটাতো বিফল হলো। কিন্তু যারা দুনিয়াকে অবজ্ঞা
করে দ্বীনকে আঁকড়িয়ে ধরে, দুনিয়াবাসী তাঁদের পিছনে ঝুঁকে পড়ে, সম্পদ তাঁদের পদতলে গড়াগড়ি খায়।
ইয়াযীদের দরবারে শহীদ পরিবার ও ইয়াযীদের
ভন্ডামী
ইয়াযীদী বাহিনী আশি
হাজার দিরহামের অনুশোচনা করতে করতে দামেস্কে পৌঁছল এবং ইয়াযীদের দরবারে গিয়ে
সমস্ত ঘটনার বিবরণ দিল। ইয়াযীদ সমস্ত ঘটনা শুনে বলল, ইবনে যিয়াদ খুবই বাড়াবাড়ি করেছে। আমি ওকে এতটুকু করতে
বলিনি। এমনকি অনেক কিতাবে লিখা হয়েছে যে, ইবনে যিয়াদের প্রতি ইয়াযীদ লা’নত দিয়েছিল। অর্থাৎ সে বলেছিল, আল্লাহ তায়ালা ইবনে যিয়াদের উপর লা’নত করুন। ইবনে যিয়াদ খুবই অত্যাচার করেছে, আমার উদ্দেশ্য তা ছিল না। আমার উদ্দেশ্য
ছিল, হযরত ইমাম হুসাইন
আলাইহিস সালামকে যেন নজর বন্দী করে রাখা হয়, যাতে লোকেরা আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করে। কিন্তু এ ধরনের
কথার দ্বারা ইয়াযীদ রেহাই পেতে পারে না। যা কিছু হয়েছে ইয়াযীদের ইঙ্গিতেই
হয়েছে। সে ইবনে যিয়াদকে সর্বময় ক্ষমতা প্রদান করেছিল যেন সে যা প্রয়োজন হয়,
তা করে। যাতে তার বিরুদ্ধে গড়ে উঠা
বিদ্রোহ দমন হয়ে যায়। ইয়াযীদ ভনিতাপূর্ণ দরদমাখা কথা-বার্তা এজন্যে বলেছিল,
যাতে লোকজন তার বিরুদ্ধে চলে না যায়
এবং লোকেরা যেন মনে করে, সে
এ ধরনের আচরণ করার পক্ষপাতি ছিল না। এসব কথার কারণে অনেক লোক ইয়াযীদকে ভাল বলে
আখ্যায়িত করে তাদের রচিত কিতাবে লিখেছে যে, ‘ইয়াযীদ এ শাহাদাতে রাজী ছিল না। সুতরাং, ইয়াযীদ নয় বরং ইবনে যিয়াদই এ ঘটনার
জন্য দায়ী।’
মূলতঃ এ ঘটনার জন্য
ইয়াযীদই দায়ী ছিল। যার কারণে আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত-এর নির্ভরযোগ্য কিতাব ‘কিতাবুল আক্বায়িদ’-এ লিখা হয়েছে, ইয়াযীদের উপর, ইবনে যিয়াদের উপর, আহলে বাইত-এর সদস্যগণের শহীদকারীদের উপর
লা’নত বর্ষিত হোক। যদি
ইয়াযীদ নির্দোষ ও নিষ্পাপ হতো তাহলে হযরত ইমাম নাসাফী আলাইহিস সালাম তাঁর ‘কিতাবুল আক্বায়িদ’-এ এ ধরনের কথা কখনও লিখতেন না। আর
ইয়াযীদের পরবর্তী পদক্ষেপে তার আসল রূপ আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এতকিছু বলার পরও সে
শহীদগণের মস্তক মুবারক গুলোকে রাতে রাষ্ট্রীয় ভবনের শাহী দরজায় টাঙ্গানোর জন্য
এবং দিনে দামেস্কের অলিতে-গলিতে ঘুরানোর নির্দেশ দিয়েছিল। নির্দেশ মত মস্তক
মুবারকসমূহ দামেস্কের অলি-গলিতে ঘুরানো হয়েছিল।
নূরে মুজাস্সাম,
হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বিশিষ্ট ছাহাবী হযরত মিনহাল বিন্ আমর রদ্বিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহু বর্ণনা করেছেন, খোদার
কসম! আমি স্বচক্ষে দেখেছি যে, যখন
হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার মস্তক মুবারক বর্শার অগ্রভাগে উঠিয়ে
দামেস্কের গলিতে এবং বাজারসমূহে ঘুরানো হচ্ছিল, তখন মিছিলের আগে আগে এক ব্যক্তি কুরআন শরীফ-এর সূরা কাহাফ
তিলাওয়াত করছিল। যখন সে এ আয়াতে কারীমা-
ام
حسبت ان اصحاب الكهف والرقيم كانوا من ايتنا عجبا
অর্থাৎ ‘নিশ্চয়ই আছহাবে কাহাফ
ও রক্বীম আমার নিদর্শনসমূহের মধ্যে এক আশ্চর্যজনক নিদর্শন ছিল’ (সূরা
কাহাফ-৯) পাঠ করছিল তখন হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম
উনার বিচ্ছিন্ন মস্তক মুবারক থেকে আওয়াজ বের হলো- اعجب من اصحاب الكهف قتلى
وحملى অর্থাৎ ‘আছহাবে কাহাফ-এর ঘটনা থেকে আমার শাহাদাত এবং আমার
মস্তক নিয়ে ঘুরাফেরা আরও অধিক আশ্চর্যজনক।’ আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ
ফরমান- ولاتقولوا لمن يقتل فى سبيل
الله اموات‘যারা
আমার রাস্তায় শহীদ হয়েছে, তাদেরকে মৃত বলো না।’ (সূরা
বাক্বারা-১৫৪) হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার মস্তক মুবরাক
তা প্রমাণ করে দিল।