নোটিশ

শনিবার, ২১ জানুয়ারী, ২০১২

কারবালার হৃদয় বিদারক ইতিহাস (১৬)



শহীদ পরিবারের মদীনা শরীফ প্রত্যাবর্তন

এরপর ইয়াযীদ হযরত নুমান বিন বশীর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে তলব করল, যিনি একজন বিশিষ্ট ছাহাবী ছিলেন। উনাকে ডেকে বলল, আপনার সাথে আরো ত্রিশজন লোক নিয়ে শহীদ পরিবারের সদস্যদেরকে বাহনযোগে মদীনা মুনাওওয়ারায় পৌঁছিয়ে দিয়ে আসুন। হযরত নুমান বিন বশীর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এ প্রস্তাবকে সানন্দে গ্রহণ করলেন এবং নিজের জন্য সৌভাগ্যের বিষয় মনে করলেন। অতঃপর ত্রিশজন সহকর্মীসহ হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার পরিবারের সদস্যদেরকে নিয়ে মদীনা মুনাওওয়ারার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন।
হযরত যয়নাব আলাইহাস সালাম হযরত নুমান বিন বশীর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে বললেন, আমাদেরকে কারবালার পথ দিয়ে নিয়ে যান। আমরা দেখে যেতে চাই, আমাদের শহীদদের দেহ মুবারক সেইভাবে পড়ে আছে, না কেউ দাফন করেছে। যদি দাফনবিহীন অবস্থায় পড়ে থাকে, প্রথমে আমরা তাঁদেরকে দাফন করবো, এরপর ওখান থেকে রওয়ানা হবো। আর যদি কেউ দাফন করে থাকে, তাহলে তা দেখে অন্ততঃ কিছুটা সান্ত¡না পাব। হযরত নুমান বিন বশীর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হযরত যয়নাব আলাইহাস সালাম-এর কথার প্রতি সম্মতি জ্ঞাপন করলেন এবং কারবালার পথ ধরলেন। কারবালায় গিয়ে হযরত যয়নাব আলাইহাস সালাম সেই প্রান্তর যখন দেখলেন, যেই প্রান্তরে উনাদের আপনজনদেরকে নির্মমভাবে শহীদ করা হয়েছিল, হঠাৎ উনি অপ্রত্যাশিতভাবে চিৎকার করে উঠলেন এবং অঝোরে কাঁদতে শুরু করলেন এবং কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, এখানে হযরত আলী আছগরের দেহ মুবারক পড়েছিল, ওখানে হযরত আলী আকবরের দেহ মুবারক পড়ে ছিল, এখানে আমার ভাই হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার দেহ মুবারক পড়েছিল। তিনি এভাবে যখন হাতের আঙ্গুল দ্বারা দেখিয়ে দেখিয়ে দেহ মুবারকগুলোর অবস্থানের কথা বলছিলেন, তখন সবারই মুখ থেকে ক্রন্দনের করুণ আওয়াজ বের হচ্ছিল।

কারবালার নিকটবর্তী একটি গ্রাম ছিল, যার নাম ছিল আমরিয়া। ইয়াযীদ বাহিনী চলে যাওয়ার পর ঐ আমরিয়া গ্রামের অধিবাসীরা এসে শহীদদের দেহ মুবারকসমূহ দাফন করেছিল। মদীনা শরীফ থেকেও একটি দল হযরত জাবির বিন আব্দুল্লাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার নেতৃত্বে কারবালায় এসে পৌঁছেছিল। শহীদ পরিবারের কাফেলা যখন কারবালার প্রান্তরে পৌঁছল, সেই সময় মদীনা শরীফ থেকে আগত দল ও আমরিয়া গ্রামের অধিবাসীরাও উপস্থিত ছিল। তারা যখন এ মজলুম কাফেলাকে দেখলো তখন আর এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হল। ঘটনাক্রমে সেদিন ছিল ২০শে সফর অর্থাৎ শহীদদের চেহলামেরদিন। কাফেলার সবাই সেই রাত সেখানেই অতিবাহিত করেন। সারা রাত তাঁরা কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করেন, দুয়া-দুরূদ শরীফ পাঠ করেন এবং খাবারের জন্য খিচুড়ী পাকান। আজকাল মুসলমানগণ যেরূপ কারো ইন্তিকালের পর ফাতিহা পাঠ বা ঈছালে ছওয়াব উপলক্ষে খিচুড়ী বা অন্য তাবারুকের ব্যবস্থা করে থাকেন। এটা মূলতঃ উনাদেরই স্মৃতিচারণ।

শহীদ পরিবার কারবালার প্রান্তরে একদিন এক রাত অবস্থানের পর মদীনা মুনাওওয়ারার পথে রওয়ানা হলেন। কাফেলা যখন মদীনা মুনাওওয়ারার সন্নিকটে পৌঁছল এবং চোখের সামনে মদীনা শরীফ-এর দৃশ্য দেখা যাচ্ছিল, তখন সবারই চোখ আবার অশ্রু সজল হয়ে উঠলো এবং একান্ত ধৈর্য ও ছবরের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে অগ্রসর হলেন। এদিকে তাঁদের আগমনের খবর বিদ্যুৎ গতিতে সমগ্র মদীনা মুনাওওয়ারায় ছড়িয়ে পড়ে। সেই সময় হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার বড় মেয়ে হযরত ফাতিমা আলাইহিস সালাম আলাইহা মদীনা শরীফ-এ ছিলেন, যাঁর সাথে হযরত ইমাম হাসান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার বড় ছেলের বিবাহ হয়েছিল। হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার ভাই হযরত মুহম্মদ বিন হানাফিয়া আলাইহিস সালাম আলাইহিও মদীনা শরীফ-এ ছিলেন, হযরত মুসলিম বিন আকিল আলাইহিস সালাম আলাইহি-এর মেয়ে ও বোনেরাও তখন মদীনা শরীফ-এ ছিলেন। নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আহলিয়া উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহাও মদীনা শরীফ-এ ছিলেন। উনারা সকলেই এবং মদীনা শরীফ-এর প্রতিটি ঘরের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা প্রত্যেকেই মজলুম কাফেলাকে এক নজর দেখার জন্য ঘর থেকে বের হয়ে আসলেন।

হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার বড় মেয়ে হযরত ফাতিমা আলাইহিস সালাম আলাইহা যখন মজলুম কাফেলাকে এগুতে দেখলেন, তখন একান্ত ছবর ও ধৈর্যশীলা হওয়া সত্ত্বেও অজান্তে হু হু করে কেঁদে উঠলেন এবং ফুফু হযরত যয়নাব আলাইহাস সালামকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলেন, ফুফু! আমার আব্বাজানকে কোথায় রেখে এসেছেন? আমার ভাই আলী আছগর ও আলী আকবরকে কোথায় রেখে এসেছেন? আমার চাচাতো ভাই ক্বাসিমকে কোথায় রেখে এসেছেন? আমার আব্বাস চাচাজান কোথায়? আমাদের ভরপুর ঘর কোথায় লুণ্ঠিত হলো? হযরত ফাতিমাতুয্্ যাহরা আলাইহস সালাম উনার সুশোভিত বাগানকে কারা ছিন্নভিন্ন করলো? এভাবে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করতে লাগলেন তখন এমন এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল যে, একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে অনেকে বেহুঁশ হয়ে গিয়েছিলেন। লোকেরা অনেক সান্তনা দিয়ে, ছবর ও ধৈর্যের কথা বলে কাফেলাকে মদীনা শরীফ-এ নিয়ে আসলেন।





হযরত ইমাম যাইনুল আবিদীন আলাইহিস সালাম উনার রওজা শরীফ-এ উপস্থিতি

মজলুম কাফেলার সকলেই যখন কান্নায় ভেঙে পড়লেন তখন কাফেলার একমাত্র জীবিত পুরুষ সদস্য হযরত ইমাম যাইনুল আবিদীন আলাইহিস সালাম শোকে পাথর হয়ে এক কিনারে দাঁড়িয়েছিলেন। সবাই যখন উনাকে ঘরে যাওয়ার জন্য জোর করলেন, তিনি বললেন, আমার আব্বাজান ওছীয়ত করেছেন, মদীনা শরীফ পৌঁছে যেন সবার আগে তাঁর নানাজান ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার রওজা শরীফ-এ হাজিরা দিই। তাই আমি রওজা পাকে যাওয়ার আগে কোথাও যাব না। অতঃপর তিনি রওজা শরীফ-এ গিয়ে পৌঁছলেন। হযরত যাইনুল আবিদীন আলাইহিস সালাম যিনি এতক্ষণ পর্যন্ত ছবর ও ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে নিশ্চুপ ছিলেন, তিনি রওজা পাক-এর সামনে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। শুধু এতটুকু বলতে পারছিলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনার দৌহিত্র হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার সালাম গ্রহণ করুন। এরপর তাঁর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল এবং অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে তাঁর চোখের দেখা কারবালার সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করতে লাগলেন। আর তাঁর কান্নার সাথে সাথে মদীনা শরীফ-এর সমস্ত দেয়াল থেকে কান্নার রোল বের হচ্ছিল এবং রওজা মুবারকও থরথর করে কাঁপছিল এবং সেখান থেকে আওয়াজ বের হলো, যাইনুল আবিদীন! তুমি আমাকে কী শুনাচ্ছ? আমি তো সব কিছু স্বচক্ষে দেখেছি।
মদীনাবাসী হযরত ইমাম যাইনুল আবিদীন আলাইহিস সালাম উনাকে ধৈর্য ধারণের কথা বললেন, আল্লাহ তায়ালার যা হুকুম ছিল, তা হয়েছে। নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সম্মানিতা আহলিয়া উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালামা আলাইহাস সালাম তিনি বর্ণনা করেন, মদীনা শরীফ-এ একবার সেই দিন ক্বিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যেই দিন নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তায়ালার সান্নিধ্যে গমন করেছিলেন। আর একদিন ক্বিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হলো, যেদিন হযরত ইমাম যাইনুল আবিদীন আলাইহিস সালাম কারবালা থেকে ফিরে এসেছেন। উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা আরো বর্ণনা করেন, নূরে মুজাস্সাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বিছাল শরীফ-এর দিন অদৃশ্য থেকে যেভাবে ক্রন্দনের আওয়াজ শুনা গিয়েছিল, হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার শাহাদাতের সময় একইভাবে অদৃশ্য থেকে কান্নার আওয়াজ শুনা গিয়েছিল।

রওজা শরীফ-এ হাজিরা দিয়ে সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করার পর হযরত ইমাম যাইনুল আবিদীন আলাইহিস সালাম ঘরে গেলেন এবং একান্ত ছবর ও ধৈর্য সহকারে মদীনা শরীফ-এ অবস্থান করতে লাগলেন। হযরত ইমাম যাইনুল আবিদীন আলাইহিস সালাম-এর এমন অবস্থা হয়েছিল যে, যখন তিনি পানি দেখতেন সীমাহীন কান্নাকাটি করতেন এবং বলতেন, এই সেই পানি, যা আলী আছগরের ভাগ্যে জোটেনি, হযরত আলী আকবরের ভাগ্যে জোটেনি, আহলে বাইত-এর সদস্যদের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। উনার সামনে যখন খাবার আনা হতো তিনি দুএক লোকমা মুখে দিয়ে অবশিষ্টগুলো সামনে থেকে নিয়ে যেতে বলতেন। সবসময় একাকী থাকতে পছন্দ করতেন। সাধারণ লোকদের সাথে মেলামেশা করতেন না এবং যতদিন পর্যন্ত জীবিত ছিলেন, কোনদিন হাসেননি। উনার ছেলে হযরত ইমাম মুহম্মদ বাকির আলাইহিস সালাম একদিন উনাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আব্বাজান! কী ব্যাপার? আমি আপনাকে কোনদিন হাসতে দেখিনি। তিনি বললেন, বৎস! আমার চোখের সামনে কারবালার যে দৃশ্য ফুটে রয়েছে, তা দেখলে তোমার মুখ থেকেও চিরদিনের জন্য হাসি বন্ধ হয়ে যেত! তুমিও সারা জীবনে কোনদিন হাসতে না। বৎস! আমি পুতঃপবিত্র শরীর মুবারককে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে দেখেছি, প্রিয় নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নকশা মুবারককে দাফন-কাফনবিহীন অবস্থায় কারবালার প্রান্তরে পড়ে থাকতে দেখেছি। আমি নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রিয় দৌহিত্রকে আঘাতে জর্জরিত হয়ে কারবালার তপ্ত বালি-রাশির উপর দাফন-কাফনবিহীন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেছি।

হযরত উলামায়ে কিরামগণ লিখেছেন, এই পৃথিবীতে পাঁচজন ব্যক্তি খুব বেশি কান্নাকাটি করেছেন। তাঁরা হলেন- এক. হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম, জান্নাত থেকে যমীনে তাশরীফ আনার পর খুবই কান্নাকাটি করেছেন। দুই. হযরত ইয়াহ্ইয়া আলাইহিস্ সালাম, আল্লাহ তায়ালার ভয়ে খুবই কেঁদেছিলেন। তিনি এত বেশি কান্নাকাটি করেছিলেন যে, দুগাল মুবারক বেয়ে চোখের পানি পড়তে পড়তে চেহারা মুবারকে দাগ পড়ে গিয়েছিল। তিন. হযরত ইয়াকূব আলাইহিস সালাম, হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম-এর বিচ্ছেদের কারণে খুবই কেঁদেছিলেন এবং অজস্র ধারায় চোখের পানি ফেলেছিলেন। চার. সাইয়্যিদাতু নিসায়ি আহ্লিল জান্নাহ হযরত ফাতিমাতুয্ যাহরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা, নূরে মুজাস্সাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বিছাল শরীফ-এর পর খুবই কেঁদেছিলেন। পাঁচ. হযরত ইমাম যাইনুল আবিদীন আলাইহিস সালাম কারবালার ঘটনার পর অনেক কেঁদেছিলেন।