হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার জিহাদের
ময়দানে গমন
হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম তাঁবুর অভ্যন্তরে
প্রবেশ করলেন। তখন তাঁর চৌদ্দ বছর বয়স্ক ছেলে হযরত ইমাম যাইনুল আবিদীন আলী আওসাত
আলাইহিস সালাম, যিনি মারাত্মক রোগ ও জ্বরে ভুগছিলেন, হেলিয়ে দুলিয়ে কোন মতে আব্বাজানের সামনে এসে আরজ
করলেন, আব্বাজান! আমাকেও বিদায় দিন, আমিও শাহাদাত বরণ করতে চাই। তিনি নিজের অসুস্থ
ছেলেকে সান্ত¡না দিলেন এবং বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, যাইনুল আবিদীন! তোমাকেও যদি বিদায় দিই, তাহলে ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু
উনার ‘সিলসিলা’ কার থেকে জারি হবে? বাবা শোন! তোমার থেকেই আমার বংশের ‘সিলসিলা’ জারি হবে। আমি দুআ
করছি, আল্লাহ পাক তোমাকে জীবিত রাখুন এবং তোমার থেকে
আমার বংশধরের ‘সিলসিলা’ জারি রাখুন।তিনি উনাকে বাতিনী খিলাফত ও ইমামত প্রদান করলেন। উনাকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে বাতিনী নিয়ামত প্রদান করলেন এবং কিছু ওছীয়ত করার পর ফরমালেন, প্রিয় বৎস! আমি চলে যাওয়ার পর মদীনা শরীফ-এ পৌঁছার যদি সৌভাগ্য হয়, তাহলে সবার আগে তোমার নানাজান ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার রওযা শরীফ-এ গিয়ে সর্বপ্রথম আমার সালাম বলবে এবং কারবালায় তোমার দেখা সমস্ত ঘটনা উনাকে শুনাবে।
হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার বীর বিক্রম
আক্রমণ
হযরত ইমাম হুসাইন
আলাইহিস সালাম ইয়াযীদী বাহিনীর সামনে গিয়ে বললেন, দেখ, আমি
কে? আমি হলাম জান্নাতের
যুবকদের সাইয়্যিদ। আমি ঐ হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, যাঁকে রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম চুমু দিতেন এবং বলতেন, এটা
আমার ফুল। আমি ঐ হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, যাঁর মা সাইয়্যিদাতু নিসায়ি আহলিল জান্নাহ হযরত ফাতিমাতুয্্
যাহরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা। আমি ঐ হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু,
যাঁর পিতা হযরত আলী র্ক্রাামাল্লাহু
ওয়াজ্্হাহু রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, যিনি খাইবর বিজয়ী। আমি ঐ হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু,
যখন আল্লাহ পাক উনার নবী হুযূর পাক
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সিজদারত অবস্থায় থাকতেন, আমি উনার পিঠ মুবারকের উপর সওয়ার হয়ে
যেতাম আর তখন উনি সিজদাকে দীর্ঘায়িত করতেন। ওহে নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম উনার ঘরকে উচ্ছেদকারীরা! ওহে হযরত ফাতিমাতুয্্ যাহরা আলাইহস সালাম উনার
বাগানের ফুলকে ছিঁড়ে ছিন্ন-ভিন্ন করে কারবালার উত্তপ্ত বালিতে নিক্ষেপকারীরা! এসো,
আমার রক্তের দ্বারাও তোমাদের হাতকে
রঞ্জিত করো। আমার পিছনে আর কেউ নেই। একমাত্র আমিই রয়েছি। এগিয়ে এসো। তখন ওরা
তলোয়ার খাপ থেকে বের করে তীর উত্তোলন করে এগিয়ে আসলো। কিন্তু হযরত ইমাম হুসাইন
আলাইহিস সালাম যখন খাপ থেকে তলোয়ার বের করে ওদের উপর আক্রমণ করলেন, তখন ওরা মেষের মত ছুটে পালাতে লাগলো।
কিন্তু হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার তলোয়ার বিদ্যুৎ বেগে ওদের উপর চলতে
শুরু করলো এবং ওদের শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন হয়ে এমনভাবে পতিত হতে লাগলো যেমন
শীতকালে বৃক্ষের পাতা ঝরে পড়ে। শেরে খোদার আওলাদ হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম
লাশের স্তূপ করে ফেললেন। তিনি নিজে তীরের আঘাতে জর্জরিত এবং তিনদিনের তৃষ্ণায়
কাতর হওয়া সত্ত্বেও তাঁর তলোয়ার ‘যুলফিকার’
তখনও সেই নৈপুণ্য দেখিয়ে যাচ্ছিল,
যেভাবে বদরের যুদ্ধে দেখিয়েছিল। বদরের
যুদ্ধে এ তলোয়ার যখন শেরে খোদা হযরত আলী র্ক্রাামাল্লাহু ওয়াজ্্হাহু
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার হাতে ছিল এবং চালানো হচ্ছিল, তখন অদৃশ্য থেকে আওয়াজ আসছিল- ‘লা ফাতা ইল্লা আলী, লা সাইফা ইল্লা যুল্ফিকার’ অর্থাৎ ‘ হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার মত যেমন কোন জওয়ান
নেই, তেমনি ‘যুলফিকার-এর মত কোন তলোয়ার নেই।’
বদর যুদ্ধের ন্যায় কারবালার ময়দানেও
সেই তলোয়ার নৈপুণ্য দেখিয়ে যাচ্ছিল।
মোট কথা, হযরত ইমাম হুসাইন
আলাইহিস সালাম লাশের স্তুপ করে ফেললেন। ইয়াযীদী বাহিনীকে কেটে কেটে মাটি রঞ্জিত
করে ফেললেন। একদিকে তিনি যেমন অনেক ইয়াযীদী সৈন্যকে কচুকাটা করে ছিলেন অন্যদিকে
ওরাও উনাকে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করে ফেললো।
হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম আনহু উনার
শাহাদাত
ইয়াযীদী বাহিনীর
মারাত্মক পরিণতির কথা উপলব্ধি করে আমর বিন সা’আদ নির্দেশ দিল, সবাই
মিলে চারিদিক থেকে হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালামকে লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করো।
নির্দেশমত ইয়াযীদী বাহিনী উনাকে চারিদিক থেকে ঘিরে বৃষ্টির মত তীর নিক্ষেপ করতে
লাগলো। ফলে চারিদিক থেকে তীর এসে হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালামকে আঘাত হানতে
লাগলো। কোনটা ঘোড়ার গায়েও লাগছিল, কোনটা
উনার নিজের গায়ে পড়ছিল। এভাবে যখন তীরের আঘাতে উনার পবিত্র শরীর ঝাঁঝরা হয়ে
ফিনকি দিয়ে সারা শরীর মুবারক থেকে রক্ত বের হতে লাগলো। তখন উনি বার বার মুখে হাত
দিয়ে বললেন, বদবখতের দল! তোমরাতো
তোমাদের নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার লেহাজও করলে না। তোমরা
নিজের নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বংশধরকে কতল করছো! এভাবে যখন তিনি
আর একবার মুখের উপর হাত দিলেন, তাঁর
চোখের সামনে আর এক দৃশ্য ভেসে উঠল। তিনি দেখতে পেলেন, স্বয়ং হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাত মুবারকে
একটি বোতল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। হযরত আলী র্ক্রাামাল্লাহু ওয়াজ্্হাহু
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ও হযরত ফাতিমাতুয্্ যাহরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা
আনহাও পার্শ্বে আছেন আর বলছেন, ‘হুসাইন!
আমাদের দিকে তাকাও, আমরা
তোমাকে নিতে এসেছি।’
হযরত ইমাম হুসাইন
আলাইহিস সালাম উনার কাপড় রক্তে ভিজে যাচ্ছিল আর হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম সেই রক্ত বোতলে ভরে নিচ্ছিলেন এবং বলছিলেন, ‘হে আল্লাহ পাক! হুসাইনকে পরম ধৈর্য
ধারণের ক্ষমতা দান করুন।’ নবী
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রিয় দৌহিত্র নিজের রক্তে রঞ্জিত হয়ে
গেলেন। শরীর থেকে রক্ত বের হয়ে গিয়ে একেবারে রক্তশূন্য হয়ে পড়লেন এবং আঘাতে
আঘাতে জর্জরিত হয়ে ঘোড়া থেকে পড়ে গেলেন। যে মুহূর্তে হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস
সালাম ঘোড়া থেকে পড়ে গেলেন, আল্লাহ
পাক উনার আরশ দুলতে লাগলো, হযরত
ফাতিমাতুয্্ যাহরা আলাইহস সালাম উনার আত্মা মুবারক যেন ছটফট করতে লাগলো, হযরত আলী র্ক্রাামাল্লাহু ওয়াজ্্হাহু
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার রূহ মুবারক থেকে যেন ‘আহ’ শব্দ
উচ্চারিত হলো। সেই হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম যমীনে পড়ে গেলেন, যাকে প্রিয় নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম নিজের কাঁধ মুবারকে নিতেন। ঘোড়া থেকে পড়ে যাওয়ার পর কমবখ্্ত সীমার,
হাওলা বিন ইয়াযীদ, সেনান বিন আনাস প্রমুখ বড় বড় জালিম
এগিয়ে আসলো এবং হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার শরীর মুবারকের উপর চেপে
বসলো। সীমার বুকের উপর বসলো। হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম বুকের উপর সীমারকে
দেখে বললেন, আমার নানাজান
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঠিকই বলেছেন, ‘এক হিংস্র কুকুর আমার আহলে বাইতের রক্তের উপর মুখ দিচ্ছে’,
আমার নানাজান ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম উনার কথা মুবারক নির্ঘাত সত্য, তুমিই
আমাকে শহীদকারী। আজ জুমুয়ার দিন। এ সময় লোকেরা আল্লাহ পাক উনার দরবারে সিজদারত।
আমার মস্তকটা তখনই আমার শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করো, যখন আমিও সিজদারত থাকি।’
আল্লাহু আকবর! দেখুন,
হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম জীবন
সায়াহ্নের সেই মুহূর্তেও পানি পান করার ইচ্ছা প্রকাশ করেননি, নিজের ছেলেমেয়েকে দেখার জন্য আরজু
করেননি, সেই সময়ও আকাঙ্খা বা
আরজু এটাই ছিল যে, আমার মাথা নত হলে যেন
আল্লাহ পাক উনার সমীপেই নত হয়।
হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম সিজদায় মাথা
রাখলেন এবং سبحان ربى الاعلى‘সুবহানা রব্বিইয়াল আ’লা’ তাসবীহ পাঠ করে বললেন, মাওলা! যদি হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার
কুরবানী আপনার দরবারে গৃহীত হয়, তা’হলে এর ছওয়াব নানাজান ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম উনার উম্মতের উপর বখশিশ করে দিন। হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার
মস্তক মুবারক যখন শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হলো, তখন
উনার ঘোড়া স্বীয় কপালকে উনার রক্তে রঞ্জিত করল এবং দৌড়ে চলে যেতে লাগল, তখন সীমার লোকদেরকে বলল, ঘোড়াটিকে ধরো, কিন্তু যতজন লোক
ঘোড়াটি ধরতে এগিয়ে গেল, সে সবাইকে আক্রমণ করল এবং দাঁত আর পা দিয়ে জখম
করে ওদেরকে শেষ করে দিল। সতের জন লোককে এভাবে খতম করল। শেষ পর্যন্ত সীমার বলল, ছেড়ে দাও, দেখি কি করে? ঘোড়া ছুটে গিয়ে তাঁবুর কাছে গেল এবং কান্না ও
চিৎকার করতে লাগলো।