নোটিশ

শনিবার, ২১ জানুয়ারী, ২০১২

কারবালার হৃদয় বিদারক ইতিহাস (১৩)



হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার শহীদী দেহ মুবারকের পার্শ্বে হযরত যয়নাব আলাইহাস সালাম

হযরত যয়নাব আলাইহাস সালাম যখন ঘোড়ার কান্না ও চিৎকার শুনলেন, তখন তিনি হযরত সখিনা আলাইহিস সালাম আলাইহাকে ডেকে বললেন, বেটি! একটু দাঁড়াও, আমি বের হয়ে দেখে আসি, সম্ভবতঃ তোমার আব্বা এসেছেন। মজলুম বোন বের হয়ে দেখলেন, ঘোড়ার জীন খালি এবং ঘোড়ার কপাল রক্তে রঞ্জিত। তা দেখে হযরত যয়নাব আলাইহাস সালাম বুঝতে পারলেন,
হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম শাহাদাত বরণ করেছেন এবং তিনি চিৎকার দিয়ে বলে উঠলেন- واه حسينا ওয়াহ্্ হুসাইনা واه غريبا ওয়াহ্্ গরীবা।তাঁর এ আওয়াজ শুনার সাথে সাথে তাঁবুর অভ্যন্তরে ক্রন্দনের রোল পড়ে গেলো। হযরত যয়নাব আলাইহাস সালাম ডাক দিয়ে বললেন, শহরবানু! সখিনাকে থামিয়ে রেখ, আমি ভাইয়ের খবর নিতে যাচ্ছি।

হযরত ফাতিমাতুয্্ যাহরা আলাইহস সালাম উনার কন্যা হযরত যয়নাব আলাইহাস সালাম; যার মাথার ওড়নাও কোন অপরিচিত ব্যক্তি কখনো দেখেনি, যিনি ঘরের চৌহদ্দি থেকে কখনো বের হননি, আজ পরদেশে অসহায় অবস্থায় মুখের উপর পর্দা ফেলে ভাইয়ের শহীদী দেহ মুবারক দেখার জন্য কারবালার ময়দানের দিকে ছুটে চললেন। যেতে যেতে তিনি বলতে লাগলেন, ‘ওহে যালিমেরা! পথ ছেড়ে দাও, আমার ভাইকে দেখতে দাও।ওরা বলল, আপনি উনাকে কি দেখবেন? উনার মাথা মুবারক শরীর মুবারক থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে।

হযরত যয়নাব আলাইহাস সালাম গিয়ে ভাইয়ের রূহবিহীন, মস্তকবিহীন দেহ মুবারক দেখে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন, আর বলতে লাগলেন, ভাইজান! আপনিতো আমাদেরকে যালিমদের হাওলা করে চলে গেলেন।

হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার শহীদী দেহ মুবারক কারবালার যমীনে পড়ে রইল। যেসব লোকেরা হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার শহীদী দেহ মুবারক দাফন করেছিলেন, তারা বলেছেন যে, হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার শরীর মুবারকে চৌঁত্রিশটি বর্শার ছিদ্র , চল্লিশটা তলোয়ারের আঘাত এবং একশত একুশটি তীরের জখম ছিল।
হযরত যয়নাব আলাইহাস সালাম নিজের ভাইয়ের শহীদী দেহ মুবারকের পাশে বিভোর হয়ে পড়ে রইলেন; এদিকে হযরত সখিনা আলাইহিস সালাম আলাইহা, হযরত শহরবানু আলাইহাস সালাম থেকে নিজেকে মুক্ত করে কারবালার ময়দানের দিকে অঝোর নয়নে ক্রন্দনরত অবস্থায় ছুটে আসলেন এবং চিৎকার করে বলতে লাগলেন, ফুফু! আপনি কোথায়? আমার আব্বু কোথায়? আওয়াজ শুনে ফুফু ডাক দিলেন, বেটি! এদিকে এসো, তোমার মজলুম ফুফু তোমার আব্বুর পাশে বসে আছেন। হযরত সখিনা আলাইহিস সালাম আলাইহা যখন নিজের আব্বাজানকে দেখলেন, চিনতে পারলেন না। কারণ উনার সমস্ত শরীর মুবারক রক্তে রঞ্জিত ছিল এবং মস্তক মুবারক শরীর থেকে বিছিন্ন ছিল। মাছুমা সখিনা রহমতুল্লাহি আলাইহা আব্বাজানের দেহ মুবারকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বেহুঁশ হয়ে গেলেন। হযরত যয়নাব আলাইহাস সালাম হযরত সখিনা আলাইহাস সালাম উনার হাত টেনে ধরে বললেন, মা সখিনা! ওঠ, আমি তোমাকে তাঁবুতে দিয়ে আসি। আমার ভাই, আমাকে বলেছিলেন, তোমাকে সান্ত¡না দেয়ার জন্য। উনি জোর করে হযরত সখিনা আলাইহিস সালাম আলাইহাকে হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার বুক মুবারক থেকে ছাড়িয়ে তাঁবুতে নিয়ে গেলেন।

হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম ও উনার অন্যান্য সঙ্গী সাথীদের শহীদী দেহ মুবারক কারবালার ময়দানে পড়ে রইলো। ইয়াযীদী বাহিনীরা, যারা ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে মনে করেছিল তারা বিজয়ী হয়েছে, বাস্তবে তাদের এমন পরাজয়ই হয়েছে যা আর কারো হয়নি। কারণ তারা চিরতরের জন্য আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার শাফায়াত ও জান্নাত থেকে বঞ্চিত। যাক, তারা এক রাত সেখানে অবস্থান করলো। যখন তারা শুয়ে পড়ল, হযরত যয়নাব আলাইহাস সালাম মুখে পর্দা ফেলে তাঁবু থেকে পুনরায় বের হলেন। দেখলেন, হযরত ফাতিমাতুয্্ যাহরা আলাইহস সালাম উনার বাগানের জান্নাতী ফুল কারবালার প্রান্তরে পড়ে রয়েছেন। নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নয়নের মণি চকমক করছেন। হযরত যয়নাব আলাইহাস সালাম এক পলক সকল প্রিয়জনকে দেখলেন। ছবর ও ধৈর্যে অটল থাকা সত্ত্বেও অঝোরে কাঁদতে লাগলেন। কাঁদতে কাঁদতে এক এক জনকে দেখে দেখে শেষে ভাইয়ের দেহ মুবারকের পাশে আসলেন এবং বসে পড়ে বললেন, ‘ওহে আমার ভাইজান! আমি অসহায়, অপারগ, ভিন-দেশের মুসাফির। মদীনা মুনাওওয়ারা অনেক দূর। আমি কিভাবে ওখানে আপনার খবর পৌঁছাবো? আমি কিভাবে আপনার দাফন করবো?’

হযরত যয়নাব আলাইহাস সালাম মদীনা মুনাওওয়ারার দিকে মুখ করে ক্রন্দনরত অবস্থায় হাত তুলে বলতে লাগলেন, ‘ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনার দৌহিত্র হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার মস্তকবিহীন দেহ মুবারক কাফন ও দাফন বিহীন রক্তে রঞ্জিত অবস্থায় পড়ে রয়েছেন।আর এদিকে রুগ্ন হযরত যাইনুল আবিদীন আলাইহিস সালাম হাত তুলে বলছেন-
للعالـمين- ادركنى زين العابدين يارحمة
ইয়া রহমতাল্লিল আলামীন! আদরিকী যাইনাল আবিদীনঅর্থাৎ হে রহমাতুল্লিল আলামীন ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমার উপর রহম করুন।এভাবে রাত্রি অতিবাহিত করলেন।

উলামায়ে কিরামগণ লিখেছেন যে, ‘হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার শাহাদাতের সময় সূর্যগ্রহণ হয়েছিল, আসমান ঘোর অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল, ফলে দিনে তারকারাজি দৃষ্টিগোচর হয়েছিল। কিছুক্ষণ পর আকাশ কালো থেকে লাল বর্ণে পরিণত হয়েছিল এবং আসমান থেকে রক্ত বর্ষিত হয়েছিল। সাতদিন পর্যন্ত এ রক্ত বর্ষণ অব্যাহত ছিল। সমস্ত ঘর বাড়ির দেয়াল রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল এবং যেসব কাপড়ের উপর রক্ত পতিত হয়েছিল, সেসব কাপড় ছিড়ে টুকরো টুকরো হওয়ার পরও সেই রক্তের লালিমা যায়নি। যমীনও কান্নাকাটি করেছিল। বায়তুল মুকাদ্দাসে যে পাথরটা উঠানো হতো, সেই পাথরের নিচ থেকে তাজা রক্ত বের হতো। পানি ভর্তি কলস রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল। ইয়াযীদী বাহিনীরা যখন উট যবেহ করেছিল তখন সে উটের ভিতর থেকে রক্তের পরিবর্তে আগুনের লেলিহান শিখা বের হয়েছিল। জিনদের মধ্যেও শোক-বেদনা ছড়িয়ে পড়েছিল। এক অদ্ভুত ও বিস্ময়কর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল।
অনেক বেদনাবিধূর, রোমহর্ষক ঘটনার কথা স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে। কিন্তু হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার শাহাদাত অপরিসীম হৃদয় বিদারক। এর কল্পনা করাও যায় না। এর স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠলে মন-প্রাণ শিউরে ওঠে।





ইমাম পরিবারকে কূফায় আনয়ন

হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার শাহাদাতের পর ইয়াযীদী বাহিনী একরাত কারবালার প্রান্তরে অবস্থান করেছিল। পরের দিন সকালে তারা তাদের মৃতদেরকে দাফন করেছিল। কিন্তু শহীদদের দেহ মুবারকগুলো দাফন ও কাফন বিহীন অবস্থায় যেমনি ছিল, তেমনি অবস্থায় ফেলে রেখে হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার পরিবারের অবশিষ্ট মহিলা ও শিশুদেরকে বন্দি করে উটের উপর আরোহণ করিয়ে কূফার দিকে রওয়ানা দিল। চলতে চলতে তারা রাত্রি বেলা কূফার কাছে গিয়ে পৌঁছল। ঐখান থেকে মাত্র দুই মঞ্জিল দূরত্বে ছিল কূফার রাজধানী।

হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার মস্তক মুবারক নিয়ে হাওয়া বিন ইয়াযীদযখন রাত্রে কূফার রাজধানীতে এসে পৌঁছেছিল, তখন গভর্নর ভবনের শাহী দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এর জিম্মাদারী যেহেতু ওর হাতে, সেহেতু অন্য কাউকে হস্তান্তর না করে মস্তক মুবারক তার নিজের ঘরে নিয়ে গেল। ঘরে নিয়ে গিয়ে একটি মাটির বাসনের নিচে মস্তক মুবারক রেখে দিল। ওর স্ত্রী জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি এনেছ? সে উত্তরে হযরত ইমাম হুসাইন ইবনে আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার মস্তক মুবারকের কথা বললো। এটা শুনে তার স্ত্রী শিউরে উঠলো এবং বলল, ‘কী জঘন্য ব্যাপার! তোমার ঘর ধ্বংস হয়ে যাবে। হযরত ইমাম হুসাইন ইবনে আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার মস্তক মুবারক! নবী মুস্তফা ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার দৌহিত্রের মস্তক মুবারক তুমি মাটির থালার নিচে রাখতে পেরেছ! আফসুস! মানুষ ঘরে সোনা-চান্দি আনে, আর তুমি এনেছ নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার দৌহিত্রের ছিন্ন মস্তক মুবারক? আর এভাবে বেয়াদবী এবং অবজ্ঞাভরে রেখে দিয়েছ! আমি তোমার মত বদবখত্ লোকের সাথে থাকতে চাই না’- এ বলে তিনি মস্তক মুবারকের কাছে এসে সসম্মানে তা মাটি থেকে উঠিয়ে উচ্চ স্থানে রাখলেন এবং পাশে বসে ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় চিন্তা করতে লাগলেন, কী জানি আমাদের ঘরে আল্লাহ তায়ালার কোন্ গযব নাযিল হয়। এমন সময় তিনি কী দেখতে পেলেন, তা তার ভাষায় শুনুন- আমি দেখলাম, আসমান থেকে ছোট ছোট সাদা পাখির আগমন হলো এবং সেগুলো উনার মস্তক মুবারকের এদিক সেদিক উড়ছিল এবং ঘুরাঘুরি করছিল। একবার চলে যেত, আবার আসত। সারা রাত এ অবস্থায় ছিল। আর মাঝে মধ্যে মস্তক মুবারক থেকে এমন উজ্জ্বল আলো বিচ্ছুরিত হতে দেখলাম, যা আসমান পর্যন্ত আলোকিত করে ফেলত।