ফিলিস্তিনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসঃ
ইসলামের আগমন পর্যন্ত ফিলিস্তিনের প্রাচীন ইতিহাস
প্রচীনকালে কেনান নামে পরিচিত ফিলিস্তিন ভূ-খন্ডের আয়তন ২৫০০ বর্গ কিলোমিটার। দেশটি ভূমধ্যসাগরের পূর্ব উপকুল এবং মিশর, জর্দান, সিরিয়া ও লেবাননের পাশে অবসি'ত। ফিলিস্তিন একটি উর্বর ও ভারসাম্যপূর্ণ আবহাওয়ার অধিকারী দেশ। এলাকাটি হযরত মূসা আলাইহিস সালাম ও ঈসা আলাইহিস সালাম-এর মত মহান নবীদের আর্বিভাবের এবং হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম উনার চলাচল ও বসবাসের স্থান ছিল। ভূ-রাজনৈতিক দৃষ্টিতেও এর অবস্থান হচ্ছে অত্যন্ত কৌশলগত ও নাজুক।
জেরুজালেম বা বায়তুল মুকাদ্দাস শহরটি এমন এক পাহাড়ী এলাকায় অবস্থিত যার মুরিয়া পাহাড়ের চূড়ায় ইয়াহবা বা জেহুভা মন্দির রয়েছে। বায়তুল মুকাদ্দাস ফিলিস্তিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা।
শহরটি পূর্বদিক থেকে যায়ন নামক পাহাড় ও পশ্চিম দিক থেকে যয়তুন নামক পাহাড় দিয়ে ঘেরা। যায়ন তথা রৌদ্রোজ্জ্বল পাহাড়ের নাম তাওরাত ও ইঞ্জিল শরীফেও বর্ণিত হয়েছে।
ফিলিস্তিনের ঘটনাবহুল ইতিহাস অতীতকালের নবীগণের কাহিনী দিয়ে শুরু হয়। হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম উনার নাম মুবারক ছিল ইসরাইল। বনি ইসরাইল হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম উনারই বংশধর। খৃস্টপূর্ব ১৩ শতাব্দী যাবত তারা সেখানে ক্ষমতাধর ছিলেন। মিশরে ফেরাউনের রাজত্বকালে এবং হযরত মূসা আলাইহিস সালাম উনার আগমনের পূর্বে ইসরাইলীদের জনসংখ্যা খুবই বৃদ্ধি পায়। মিশরে হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম উনার আগমনের প্রায় চারশ’ তিরিশ (৪৩০) বছর পর হযরত মূসা আলাইহিস সালাম বনি ইসরাইলকে মিশর থেকে প্রতিশ্রুতি ভূ-খন্ডে স্থানান্তরের জন্য পরিচালনা শুরু করেন। এ পরিক্রমা ঘটনাবহুল চল্লিশ বছর যাবত অব্যাহত থাকে। এ সময়ই হযরত মূসা আলাইহিস সালাম যখন চল্লিশ দিনের জন্য উনার গোত্র ছেড়ে দশ অধ্যায়বিশিষ্ট খোদায়ী নির্দেশনামা আনতে অদৃশ্য হয়ে যান তখন বনি ইসরাইল পুনরায় মূর্তি পূজায় আত্মনিয়োগ করে। আর এই নাফরমানীর কারণেই চল্লিশ বছর ধরে এ সমপ্রদায় মরুভূমিতে লক্ষ্যহীনভাবে পথ হারিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
হযরত মূসা আলাইহিস সালাম এই দীর্ঘ সময় ধরেও স্বীয় বিভ্রান্ত সমপ্রদায়কে হেদায়েত দান থেকে বিরত হননি। কিন্তু বনী ইসরাইল বার বার বিদ্রোহ ও সীমালংঘন করা অব্যাহত রাখে। হযরত মূসা আলাইহিস সালাম- এর ওফাতের পর ইউশা বনী ইসরাইলীকে জর্দান থেকে দেখিয়ে নেয়ার ব্যাপারে হযরত মুসার স্থলাভিষিক্ত হন। তখন থেকে এ সমপ্রদায় যে কোন নতুন শহরে উপনীত হতো সেখানেই লুটতরাজ ও গণহত্যা চালাতো। ফলে জেরুজালেমের বাদশাহ আরো পাঁচটি শহরের বাদশাহর সাথে মৈত্রী স্থাপন করে একযোগে ইউশা ও বনী ইসরাইলের সাথে যুদ্ধে নামে। কিন্তু এরা সবাই পরাজিত হলে বনী ইসরাইল এদের ফাঁসীকাষ্ঠে ঝোলায়। তবে ফিলিস্তিনী জাতি আগ্রাসীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ অব্যাহত রাখে এবং শেষ পর্যন্ত বনি ইসরাইলকে পরাজিত করে। এরপরও দুই সমপ্রদায়ের মাঝে আরো বেশ ক’টি যুদ্ধ বাঁধে। অবশেষে বনি ইসরাইলের শক্তি বেড়ে যায় এবং বিভিন্ন শহরের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়। হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের জন্মের প্রায় এক হাজার বছর আগে হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম ফিলিস্তিনীদের হাত থেকে জেরুজালেমকে মুক্ত করতে সক্ষম হন এবং সেখানে বায়তুল মুকাদ্দাস তথা আল্লাহর ঘর নির্মাণ করেন। হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম-এর পুত্র হযরত সুলায়মান আলাইহিস সালাম বায়তুল মুকাদ্দাসের নির্মাণ কাজ সম্পূর্ণ করেন। মক্কা শরীফে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম কর্তৃক কা’বা শরীফ নির্মাণের প্রায় এগারো শ’ (১১০০) বছর পর এবং হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম-এর জন্মের নয়শ’ সত্তর (৯৭০) বছর আগে বায়তুল মুকাদ্দাস নির্মিত হয়। কা’বা ঘরের নির্মাতা হযরত ইবরাহিমের চৌদ্দতম অধঃস্তন পুরুষ হচ্ছেন হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম । অন্যদিকে মেথিউর বাইবেল অনুসারে হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম -এর সাথে হযরত দাউদের সম্পর্কে আটাশ পুরুষের। আর এভাবেই তৌহিদপন্থীদের প্রথম হারাম শরীফ হয়ে দাঁড়ায় মক্কা (কা’বা) এবং মসজিদুল আকসা (আল কুদস) পরিণত হয় দ্বিতীয় হারামে।
হযরত মুসা আলাইহিস সালাম-এর ভেলাটি হচ্ছে মুসলমানদের রেওয়ায়েত অনুসারে সেই ছোট গোলাকার ভেলা যাতে হযরত মুসার মা নবজাত মুসাকে রেখে নীলনদে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে হযরত মুসা আলাইহিস সালাম এই ভেলার ভেতর উনার নির্দেশাবলী ও ওহীর লিপিকা বোর্ডগুলো, বর্ম ও নব্যুয়তের নিদর্শনাদি রাখেন। এতে হাত দেয়ার অনুমতি কারো ছিল না। হযরত দাউদের সময় এ ভেলাটির বাইরের দিক ও ভেতরের দিকটিকে সোনার প্রলেপ দিয়ে অলঙ্ককৃত করা হয় এবং একে যায়ন পাহাড়ে নিয়ে আসেন। এরপর একে কেন্দ্র করে একটি কোরআন গাহ তৈরী করা হয়। এ ভেলাটি কিছুকাল বিজয়ী ফিলিস্তিনদের হাতে আসে। অতঃপর পুনরায় তা বনি ইসরাইলের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়। হযরত সুলায়মান আলাইহিস সালাম-এর সময় পর্যন্ত এটি যায়ন পাহাড়েই ছিল। কিন্তু বায়তুল মুকাদ্দাস নির্মাণের পর ভেলাটিকে কুদস শরীফে স্থানান্তর করা হয়। হযরত সুলায়মান আলাইহিস সালাম চল্লিশ বছর বাদশাহী করেন এবং বায়তুল মুকাদ্দাসে শান্তি প্রতিষ্ঠিত করেন। কিন্তু উনার ইন্তেকালের পর বনি ইসরাইল আবারো জুলুম-অত্যাচার ও লুটতরাজ শুরু করে। খৃষ্টপূর্ব ৭৩০ সালে শালমুনসায় বনি ইসরাইলের উপর আক্রমণ চালায় এবং এদের অনেককে বন্দী করে নেয়। এছাড়া সে জেরুজালেমে বনি ইসরাইলের বদলে ব্যাবিলনীদের অভিভাসন দান করে। খৃষ্টপূর্ব ৫৮৬ সালেও বখনাছেরের সময় ইয়াহুদী ভূখন্ডটি আশুরী সমপ্রদায়ের হামলার শিকার হলে বনি ইসরাইলের পতন ঘটে এবং এরা বন্দী হয়। এতে ইয়াহুদীদের রাজত্ব ও বাদশাহী ভেঙ্গে পড়ে এবং ইসরাইলের জনতা ছত্রভঙ্গ কিংবা ব্যাবিলনীদের হাতে বন্দী হয়। আগ্রাসীরা সুলায়মান আলাইহিস সালাম-উনার ইবাদতখানাটি ধ্বংস করে ফেলে।
আল কুদস নির্মাণের ৪৮০ বছর পূর্বে (খৃষ্টপূর্ব প্রায় তেরশো বছর আগে) ইউশা বিন নুনের নেতৃত্বে বনি ইসরাইল ও ইয়াহুদী সমপ্রদায়ের ফিলিস্তিন ভূ-খন্ডে আগমনের পর থেকে এ দেশটি আনন্দের মুখ দেখেনি। সেই থেকে আজ পর্যন্ত তিনহাজার তিনশো বছর ধরে ফিলিস্তিন ভূ-খন্ডে অশান্তির আগুনে জ্বলছে।
ইয়াহুদী সমপ্রদায়ের পরবর্তী নবীগণ, যেমন হযরত আরমিয়া আশইয়া ও দানিয়েল আলাইহিস সালাম-এর (ইরানের শুশ শহরে উনার মাজার) মত নবীরা জেরুজালেমের ধ্বংস ও বনি ইসরাইলের দুঃখ-কষ্ট ও বন্দীত্ব প্রত্যক্ষ করেছেন এবং এদের সান্ত্বনা ও প্রবোধ দিয়েছেন। তাঁরা সব সময়ই ইয়াহুদীদের মুক্তির ও মহান মুক্তিদাতার আগমনের সুসংবাদ দান করতেন। তাঁদের বাণী, কবিতা ও শ্লোক তৌরাতে উল্লেখ রয়েছে। এ সময়ই পারস্যে বাদশাহ সাইরাসের আবির্ভাব ঘটে। তিনি একের পর এক রাজ্য বিজয় শুরু করেন। এ বিষয়টি ইয়াহুদী সমপ্রদায় ও এদের নেতাদের উল্লসিত করে তুলে। শেষ পর্যন্ত সাইরাস ব্যাবিলনকেও দখল করে নিয়ে ইয়াহুদী সমপ্রদায় ও বনি ইসরাইলকে মুক্ত করে দেন এবং এদের ফিলিস্তিন ও জেরুজালেমে প্রত্যাবর্তন করান । সাইরাস সকল ধর্ম ও সমপ্রদায়ের সাথে সদাচারণ করতেন এবং তারই নির্দেশে আল্লাহর ঘর (আল্ কুদস) পুনরায় নির্মিত হয়। জেরুজালেমের শান্তিপূর্ণ অবস্থা তৃতীয় দারিউস বাদশার সময় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। খৃষ্টপূর্ব ৩২৩ সালে আলেকজান্ডার মিশর, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, ফানিকিয়া ও ইরানের উপর আগ্রাসন শুরু করেন। এতে পুনরায় এসব দেশে দেদার ধংসযজ্ঞ , গণহত্যা ও লুটতরাজ নেমে আসে। ইরান তথা পারস্যের সকল ধনভান্ডার লুট হয়ে যায়। ইরানের খুশাইয়ারবাদশা কর্তৃক এথেন্স ধ্বংস হওয়ার প্রতিশোধ হিসাবে আলেকজান্ডার তখতে জামাশদ তথা পারসেপোলিসকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করেন এবং স্বীয় অধিনায়কদের বিজিত শহর ও দেশ গুলোর শাসক হিসাবে নিয়োগ করেন।
আলেকজান্ডারের পর তার উত্তরসূরিরা ফিলিস্তিনের উপর আধিপত্য বিস্তার করে। খৃষ্টপূর্ব ৬৩ সন থেকে সেখানে রোমকদের আধিপত্য শুরু হয় ওরা আর্মেনিয়া , এশিয়ার কিছু অংশ ও আফ্রিকায় আগ্রাসন চালানোর পর সিরিয়া ও ফিলিস্তিনের উপর চড়াও হয়। এদের হাতে বারো হাজার ইয়াহুদী নিহত ও বহু শহর ধ্বংস হয়।
এরকম পরিসি'তিতে হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম-এর আগমন ছিলো ওই অঞ্চলের জনগণের জন্য আশা-ভরসা ও কামনা-বাসনার উৎস যাতে তারা মুক্তি পেতে পারে। হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম যখন জালিল প্রদেশসস্থ নাছেরায় উনার ও উনার পরিবারবর্গের জন্মস্থান ছেড়ে সাহাবীদের (হাওয়ারী) নিয়ে জেরুজালেমের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন তখন তিনি প্রচুর মুজেজা ও কেরামতি প্রদর্শন করেন। বাইবেলে (ইঞ্জিলে) এসবের পূর্ণ বিবরণ রয়েছে। হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম জেরুজালেমে (বায়তুল মুকাদ্দাসে) অবসি'ত ইবাদতগাহে সব সময় যাতায়াত করতেন এবং প্রতিদিন জনগণকে শিক্ষা-দানে মশগুল থাকতেন। এ বিষয়টি ইয়হুদী মোল্লাদের হিংসা-বিদ্বেষকে প্রজ্বলিত করে। এরা আল্লাহর নবীকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।
শেষ পর্যন্ত ইয়াহুদী পরিষদের ফতোয়ায় ও চক্রানে- ইয়াহুদী ভূ-খন্ডের রোমীয় শাসক হযরত ঈসাকে আলাইহিস সালাম ফাঁসীকাষ্ঠে ও ক্রুশে বিদ্ধ করে হত্যা করে। (অবশ্য এ শাসক হযরত ঈসার একজন ভক্ত অনুরাগী ছিল।) তবে কুরআন মজিদ হযরত ঈসার ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার কথা অস্বীকার করেছে এবং বলেছে, ‘‘আল্লাহ তাঁকে নিজের দিকে উপরে উঠিয়ে নেন। মসিহকে ওরা হত্যাও করতে পারেনি এবং ফাঁসিতেও ঝুলাতে সক্ষম হয়নি। বরং ওদের কাছে ওই রকমই প্রতিভাত হয়েছিল।’’ যাহোক হযরত ঈসা মসিহ আলাইহিস সালাম চিরন্তন হয়ে গেলেন এবং প্রচুর অনুসারী জন্ম নিলো। হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম উনার বিশেষ অনুরাগী রোমক শাসক এ ঘটনার পর থেকে ইয়াহুদীদের প্রতি কঠোর আচরণ শুরু করে। ফলে একের পর এক ইয়াহুদী বিদ্রোহ মাথা চাড়া দিয়ে উঠে আর রোমকরাও এদের ওপর ব্যাপক হত্যাকান্ড চালায়।
সত্তর খৃস্টাব্দে রোম সম্রাটের পুত্র টাইটাস আশি হাজার সৈন্য নিয়ে জেরুজালেম অবরোধ করে। ইয়াহুদীদের কয়েক মাস প্রতিরোধ সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত তারা রোমকদের হাতে ভেঙ্গে পড়ে। রোমকরা বিজয় অর্জন করলে ইয়াহুদীরা পুনরায় আশ্রয়হীন ও শরণার্থীতে পরিণত হয়। হযরত ঈসা মসিহের অন্তর্ধানের প্রায় তিন’শ বছর পর রোম সম্রাট কনস্টান্টিন (৩০৬-৩৩৭ খৃস্টাব্দ) খৃস্টান ধর্ম গ্রহণ করেন এবং এ ধর্মকে সরকারী ধর্ম হিসাব ঘোষণা দেন। ফলে জেরুজালেম আবারো বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে। যেহেতু বেথেলহামকে (বায়তুল লাহাম) হযরত ঈসার জন্মস্থান এবং উনার কথিত মাজারের কেন্দ্র বলে ধরা হয় সেহেতু এরপর থেকে জেরুজালেম খৃস্টানদের কেন্দ্রীয় শহর বলে গণ্য হতে থাকে। সেখানে বহু গীর্জা নির্মিত হয়। ১৩৫ খৃস্টাব্দ থেকে পাঁচশো বছর সময় পর্যন্ত বায়তুল মুকাদ্দাসে আঙ্গুলে গোনা কতিপয় ইয়াহুদী মাত্র বসবাস করতো।
পারস্যের সাসানী বাদশাহ দ্বিতীয় খসরুর রাজত্বকালে ইরান ও রোম সম্রাটের মাঝে ৬০৪ খৃস্টাব্দ থেকে ৬৩০ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত লড়াই চলে। এতে ইরানী সৈন্যরা রোমকদের পরাজিত করে। ইরানীদের সহায়ক ইয়াহুদী গোষ্ঠীর পথ নির্দেশ মুতাবেক ইরান জেরুজালেম (ফিলিস্তিন) দখল করে নেয়। কিন্তু সম্রাট খসরু পারভিজের মৃত্যুর পর খৃস্টানরা পুনরায় ফিলিস্তিন দখল করে নেয়।
ইসলাম আগমনের পর বায়তুল মুকাদ্দাস
হযরত রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নবুয়্যত লাভের পরের তের বছরও নবীজী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কায় বসবাস করেন। এ সময় মসজিদুল আকসা মুসলমানদের কেবলা ছিল। মদীনায় নবীজীর হিজরত করার দ্বিতীয় বছরে মদীনার নিকটবর্তী বনি সালমা মসজিদে নবীজী সাহাবীদের নিয়ে নামাজ পড়া অবস্থায় আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে মসজিদুল আকছার স্থলে মসজিদুল হারামকে (মক্কায় কা’বা শরীফ) কেবলায় পরিণত করেন। হয়তো বা ইয়াহুদীদের নিরস্ত্র করার উদ্দেশ্যই আল্লাহ পাক এ নির্দেশ দেন। কেননা ইয়াহুদীদের কেবলার দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করার কারণে ইয়াহুদীরা মুসলমানদের হেয় করতো।
হযরত রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বিছাল শরীফের পর প্রথম খলিফার সময় সিরিয়া ও ফিলিস্তিনের উদ্দেশ্যে রোমকদের শত্রুতা দমনের জন্যে সৈন্য পাঠানো হয়। কিন্তু প্রথম খলিফার ইন্তেকালের ফলে মুসলমানদের বিজয়াভিযান স্থগিত হয়ে পড়ে । দ্বিতীয় খলিফার সময় সিরিয়া ও বায়তুল মুকাদ্দাস মুসলমানদের হস্তগত হয়। রোমক সৈন্যরা মুসলমানদের হাতে পরাজয় বরণ করে। বায়তুল মুকাদ্দাসের বাশিন্দারা মুসলমানদের হাতে আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে প্রতিরোধ অব্যাহত রাখে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদী অবরোধ, খাদ্য সংকট ও রোগশোকের প্রাদুর্ভাব এদেরকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করে।
দ্বিতীয় খলিফা সাদাসিদে পোশাক গায়ে হাতে উটের রশি ধরে শহরে (জেরুজালেম) প্রবেশ করলে শহরবাসী বিস্ময় অভিভূত হয়ে পড়ে। তারা সানন্দে খলিফার সাথে শান্তি চুক্তি সম্পাদন করে। খলিাফা (হযরত ওমর) নাগরিকদের সাথে খুবই নরম ও সদয় ব্যবহার করেন। ওই বছর (১৫ হিজরী) থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস ও ফিলিস্তিন মুসলমানদের হাতেই ছিল। সন্ধি চুক্তি মুতাবিক খৃস্টানরা তাদের ধর্মীয় আচরণে স্বাধীনতা লাভ করে। পরবর্তীতে এ শহরের বাশিন্দারা বেশীর ভাগই ছিলেন আরব মুসলমান। কুদস মুসলমানদের পয়লা কেবলা হওয়ার ফলে তাদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র ও সম্মানীয় হয়ে ওঠে।
১০৯৫ খৃস্টাব্দ (৪৮৮ হিজরী) থেকে ইউরোপীয়রা মুসলমানদের উপর আগ্রাসন চালালে ক্রুসেড যুদ্ধ শুরু হয় এবং প্রায় দু’শ বছর যাবত তা অব্যাহত থাকে। ইউরোপীয়দের এসব আগ্রাসনের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল পাশ্চত্যে মুসলমানদের অতীত বিজয়ভিযানের কারণে খৃস্টানদের প্রতিশোধ গ্রহণ, প্রাচ্যের (মুসলিম জাহানের) সম্পদ-ভান্ডারের প্রতি ইউরোপীয়দের লালসা এবং ঈসার পাক মাটি জিয়ারতের মাধ্যমে বেহেশত গমন ইত্যাদি। তবে ঐতিহাসিকরা ক্রুসেড যুদ্ধের মূল কারণ হিসাবে ফিলিস্তিন ও বায়তুল মুকাদ্দাস ইস্যু, মুসলমানদের কাছে শহরের খৃস্টানদের পণদান এবং সম্ভবত ওদের সাথে অসদাচরণ ইত্যাদির কথা লিখেছে। মধ্যযুগে অর্থাৎ ৩৯৫ খৃস্টাব্দে প্রাচীন রোম সাম্রাজ্য পশ্চিম রোম ও পূর্বরোমে বিভক্ত হয়ে পড়ার সময় থেকে ১৪৫৩ খৃস্টাব্দে সুলতান ফাতিহ মুহম্মদের হাতে কনস্টান্টিনোপল (ইস্তাম্বুল) বিজয়ের আগ পর্যন্ত ইউরোপ ছিল গীর্জার স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের কেন্দ্র। পোপ যুদ্ধ শুরু করার জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন এবং পাদ্রীদের মাধ্যমে রটিয়ে দেন যে, ফিলিস্থিনে ঈসা আলাইহিস সালাম -এর আর্বিভাবের নিদের্শনাদি প্রকাশ পেয়েছে। ফলে বহু সংখ্যক খৃস্টান হযরত ঈসার আবির্ভাব দেখার জন্য বায়তুল মুকাদ্দাসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। আর পাদ্রীরা হযরত ঈসার আগমনকে বছরের পর বছর পিছিয়ে দিতে থাকে। এতে করে ফিলিস্তিনগামী জনতার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে চলে। ওদের ওসব ষড়যন্ত্রের প্রথম দিকেই একজন পাদ্রী সাতশ’ তীর্থযাত্রী নিয়ে বায়তুল মুকাদ্দাসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। কিন্তু তিনি সাইপ্রাস হয়ে ইউরোপে ফিরে যান এবং গুজব ছড়িয়ে দেন যে মুসলমানরা তাদের শহরে প্রবেশ করতে দেয়নি। এসব পটভূমি ও ষড়যন্ত্রের ফলেই এমন এক যুদ্ধের আগুন জ্বলে ওঠে যার লেলিহান শিখা দুশ’ বছর পর্যন্ত দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে। পাদ্রীদের প্রচরণা ও প্ররোচনায় তখন প্রায় সাত লাখ দরিদ্র নিঃস্ব খৃস্টান জনতা সামরিক দলপতি তথা নাইটদের সাথে আল কুদসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। পথে পথে এদর সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং কোন কোন সূত্রে এদের সংখ্যা কয়েক মিলিয়নে পৌঁছার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তিন বছরের এ পথচলা যুদ্ধ, লুটতরাজ ও ক্রমাগত অগ্রযাত্রার পর মাত্র চল্লিশ হাজার লোক বায়তুল মুকাদ্দাসে পৌঁছে। অন্যরা হয় মুসলমানদের সাথে যুদ্ধে নিহত হয়েছে কিংবা রোগে শোকে মারা গেছে।
বায়তুল মুকাদ্দাস দীর্ঘদিন অবরোধ থাকার পর তীব্র লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে ক্রুসেড বাহিনী শহরে প্রবেশ করে এবং গণহত্যা ও সর্বস্ব লুন্ঠনে হাত দেয়। ক্রুসেড বাহিনীর অধিনায়ক গোডাফর পরবর্তীতে শহরের রাজা হয়। বিজয়ের পর পোপের কাছে লিখিত পত্রে সে জানায় আপনি যদি জানতে চান বায়তুল মুকাদ্দাসে আমাদের হাতে বন্দীদের সাথে কি আচরণ করা হয়েছে তাহলো এতটুকু জেনে নিনঃ ‘আমাদের সৈন্যরা মুসলমানদের রক্তের গভীর স্রোত পাড় হয়ে সুলায়মান মন্দিরে পৌঁছে। রক্ত ঘোড়াগুলোর উরু পর্যন্ত পৌঁছেছে।’
খৃস্টানরা এভাবে (৯০) বছর ফিলিস্তিনের উপর শাসন চালায়। দ্বিতীয় ক্রুসেড যুদ্ধের শেষ দিকে (১১৪৭ খৃঃ-১১৪৯ খৃঃ তথা ৫৪২ হিঃ-৫৪৪ হিঃ) সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ুবী ক্রুসেড বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে বায়তুল মুকাদ্দাসকে উদ্ধার করেন এবং শক্রদেরকে সিরিয়া, মিশর ও অন্যান্য অঞ্চল থেকে বহিস্কৃত করেন। এরপর স্রোতের বেগে ইউরোপ থেকে সৈন্য সামন্ত ক্রুসেডারদের সাথে যোগ দিতে থাকে। আবার যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলে তৃতীয় ক্রুসেড যুদ্ধ শুরু হয় (১১৮৯ খৃঃ-১১৯২ খৃঃ/৫৮৫ হিঃ)। বায়তুল মুকাদ্দাসের পতনকে খৃস্টানদের অবমাননা বলে গণ্য করে পোপ যুদ্ধের ফতোয়া জারি করে। মুসলমানদের হাতে পরাজয়ের পর ইউরোপের সম্রাটগণ ও পোপের দল পারস্পরিক অনৈক্য ভুলে যায় এবং ফ্রান্স ও বৃটেনের রাজা উভয়ই সরাসরি যুদ্ধে নামে। এরা নিজেদের বিজয়াভিযান অব্যাহত রেখে মুসলমানদের খুনে বন্যা সৃষ্টি করতে থাকে। এদের পৈশাচিক বর্বরতার বিস্তারিত বিবরণ ইউরোপীয় ঐতিহাসিকদের যেমন, আলবার মালাহ, গোস্তাভ লোভোন ও অন্যান্যের গ্রনে' রয়েছে।
সালাহুদ্দীন আইয়ুবীর ইন্তেকালের পর আইয়ুবী বংশ শাসন কার্য চালাতে থাকে। ইউরোপ ও পোপদের সাথে রাজা-বাদশাহের প্রচুর দ্বন্দ্ব সংঘাত চলার পর অবশেষে তৃতীয় পোপ এ্যানিউসান রাজাদের কাজের অংশ হিসাবে ঘোষণা দিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নির্দেশ জারী করে। এভাবে তিন বছর সন্ধি চলার পর পুনরায় যুদ্ধের (চতুর্থ ক্রুসেড) আগুন জ্বলে উঠে। ক্রসেড বাহিনী কনস্টান্টিনোপল জয় করে নেয়, সেখানে নয়া রাজা বসায় এবং চতুর্থ ক্রুসেড যুদ্ধেরও অবসান ঘটে।
পোপ এ্যানিউসান ও তার উত্তরাধিকারীর উস্কানিতে পঞ্চম ক্রুসেড যুদ্ধের (১২১৭-১২২১ খৃঃ/৬১৪-৬১৮ হিঃ) আগুন প্রজ্বলিত হয়। পোপগণ ইউরোপীয় রাজাদের প্রতি বায়তুল মুকাদ্দাস উদ্ধারের আহবান জানান। কিন্তু ওরা তা প্রত্যাখান করে। ফলে পোপ নিজেই মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দান করে। পঞ্চম ক্রুসেড যুদ্ধে খৃস্টান বাহিনী পরাজিত হয়ে ইউরোপ ফিরে যায়।
পোপ তৃতীয় এ্যানারিউসের উস্কানিতে ষষ্ঠ ক্রুসেড যুদ্ধ বাঁধে। জার্মানীর রাজা ফ্রেডারিক প্রথমতঃ পোপের আহবানে সাড়া দেন। কিন্তু পরে অনুতপ্ত হয়ে প্রত্যাখান করে। এতে পোপ তাকে কাফের বলে ঘোষণা দেন। এতে ফ্রেডারিক পোপকে বন্দী করে নিজেই বায়তুল মুকাদ্দাসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। সে সময় আইয়ুবী বংশীয় শাসকদের ভেতর তীব্র অনৈক্য ও মতভেদকারী মুসলমানগণ ক্রুসেডারদের সাথে সন্ধি করে বায়তুল মুকাদ্দাস ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। তবে শর্ত থাকে যে, মসজিদুল আকসা মুসলমানদের হাতে থাকবে।
সপ্তম ক্রুসেড যুদ্ধ সেন্ট লুইয়ের মিশর আক্রমনের মধ্য দিয়ে শুরু (১২৪৮-১২৫৪ খৃঃ/৬৪৬-৬৫২ হিঃ) হয়। গাজা উপত্যকায় খৃস্টান বাহিনী পরাজিত হলে নবম লুই এর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য যুদ্ধে নামে। কিন্তু তিনি পরাজিত, বন্দী ও কারারুদ্ধ হন। পরে বিপুল পরিমাণে পণ দিয়ে মুসলমানদের হাত থেকে রেহাই পান। সপ্তম ক্রুসেড যুদ্ধের পর এবং আইয়ুবী বংশীয় শেষ সুলতানের ইন্তেকাল ঘটলে দাস বংশীয় শাসকরা প্রায় তিন’শ বছর যাবৎ বায়তুল মুকাদ্দাসসহ সমগ্র অঞ্চলের শাসন কার্য চালান। এদিকে ইসলামী জাহানে আক্রমণকারী একের পর এক দেশ দখলকারী মঙ্গোল বাহিনী বায়তুল মুকাদ্দাস দখলের জন্য সেখানে পৌঁছলে দাস সুলতানদের সাথে লড়াই বাঁধে। লড়াইয়ে দাস বংশের পতন ঘটে এবং আকসায় ফিলিস্তিন বসবাসকারী অবশিষ্ট খৃস্টান ক্রুসেডপন্থীদেরও মূলোৎপাটন হয়ে যায়।
অন্যদিকে মঙ্গোল বাহিনী ও গ্রীকদের সাথে উসমান গাজীর দীর্ঘ লড়াই ও একের পর এক বিজয়াভিযানের পর উসমানী বংশীয় খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়। ৭২৭ হিঃ মুতাবিক ১৩২৬ খৃস্টাব্দে উসমান গাজীর মৃত্যু ঘটে। তার বংশধররা একের পর এক শাসন কার্য চালাতে থাকে এবং এরপর সুলতান মুহাম্মদ ফাতেহের পালা আসে। সুলতান মুহাম্মদ ফাতেহ ১৪৫৩ খৃস্টাব্দে মুতাবিক ৮৫৭ হিজরীতে ক্রুসেডারদের শক্তিসামর্থ্যের কেন্দ্র ও পূর্ব রোম সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টাটিনোপল (ইস্তাম্বুল) জয় করেন এবং খৃস্টান বাহিনীকে ইউরোপের ফটক পর্যন্ত তাড়িয়ে নিয়ে যান। তিনি ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকায় তার বিজয়াভিযান অব্যাহত রাখেন। কনস্টান্টিনোপলের বিজয় ছিল ইউরোপের ইতিহাসে এক মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা।
ক্রুসেড যুদ্ধের সময়ে যেমন মুসলমানদের জ্ঞান, বিজ্ঞান ও সভ্যতা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে তেমনি এ ঘটনার ফলে ইউরোপে মধ্যযুগের অবসান ঘটে এবং রেঁনেসার বিশাল পরিবর্তন শুরু হয়ে যায়। পাঁচশ’ বছর যাবত কনস্টান্টিনোপল উসমানী সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল। এ সময়ে উসমানী খেলাফতের ভেতর শিল্প, সাহিত্য, স্থাপত্য, রাষ্ট্র পরিচালনা, উন্নয়ন, শহর স্থাপন প্রভৃতি ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়। ইউরোপীয় সরকারগুলো সব সময়ই উসমানীদের ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় ছিল।
ইরানে সাফাভী রাজবংশের পত্তন ঘটায় এবং শিয়া মাজহাবকে সরকারী মাজহাব বলে ঘোষণা দেয় এবং ইউরোপীয় সরকারগুলো, বিশেষ করে বৃটেনের প্রকাশ্য ও গোপন চক্রানে- ইরান ও উসমানীদের ভেতর দু’শ বছর মেয়াদী বহু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ অব্যাহত থাকে। উসমানীদের সাথে সন্ধি করার পর ইউরোপ যখন জ্ঞান্তবিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক (রেঁনেসা) আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঠিক তখনি ইসলামী জাহানে বিশাল ও গভীর ফাটল সৃষ্টি হয় এবং মুসলমানদের শক্তি-সামর্থ্য দীর্ঘ ধ্বংসাত্মক যুদ্ধে নষ্ট হয়ে যায়। মুসলমানরা ইসলামী সভ্যতা প্রতিরক্ষা করার বদলে অভ্যন্তরীণ গৃহযুদ্ধ ও মাজহাবী হিংসা-বিদ্বেষে মত্ত হয়।
বিংশ শতাব্দীতে বায়তুল মুকাদ্দাস ও ফিলিস্তিন
শিল্প বিপ্লবের পর দিন দিন ইউরোপের চেহারা দ্রুত বদলে যেতে থাকে। ইউরোপীয়রা জ্ঞান্তবিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিভিন্ন ক্ষেত্রে মুসলমানদের ছাড়িয়ে যায়। এ সময় ইসলামী জাহান দীর্ঘ অজ্ঞতার ঘুমে নিম্মজিত হয়। কিন্তু শিল্প বিপ্লবের ফলে ইউরোপ বিপুল পরিমান উৎপাদন ও পণ্য সামগ্রী দিয়ে অভ্যন্তরীণ বাজার ছেয়ে ফেলে। এরপর তাদের বিপুল পরিমাণ উদ্বৃত্ত পণ্য গুদামে গুদামে পড়ে থাকে। এসব পণ্য সামগ্রী বিক্রি ও প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানীর জন্য বিদেশী বাজারে আবশ্যকতা দেখা দেয়। তখন থেকেই উপনিবেশবাদী যুগের সূচনা ঘটে এবং ইউরোপীয় উপনিবেশবাদীরা বাইরের জগতের বাজার দখলের জন্যে লড়াই শুরু করে।
ইসরাইল সরকার প্রতিষ্ঠার পটভূমি এবং ফিলিস্তিনী ও আরবদের প্রতিক্রিয়া
ঊনবিংশ শতকের শেষদিকে ফিলিস্থিনে কতিপয় বিদ্রোহ দেখা দেয়। এ যাবত উসমানীদের সমর্থক বৃটেন তার নীতি বদলায় এবং বিদ্রোহীদের প্রতি সমর্থন দান করে। কেননা সে সময় বৃটেনের গুরুত্বপূর্ণ উপনিবেশ এবং বৃটেনের শক্তি ও সম্পদের উৎস ছিল ভারতবর্ষ। তাই ভারতবর্ষকে নিজ হাতে রাখার লক্ষ্যে বৃটেন এশিয়ার বিভিন্ন দেশে তার আধিপত্য সংরক্ষণ করে এবং দুই ইউরোপীয় প্রতিদ্বন্দ্বী ফ্রান্স ও রাশিয়ার পক্ষ থেকে ভারতে হামলা ঠেকানোর জন্য সুয়েজ খালের উপর দখল প্রতিষ্ঠা করা জরুরী হয়ে পড়ে। ঐ সময় সুয়েজ খাল উসমানীদের হাতে ছিল।
বৃটিশ সরকার আরবদেরকে তুর্কী উসমানীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার উস্কানি দিতে থাকে। যেমন মক্কায় আমীর হিসাবে উসমানীদের প্রতিনিধি ছিল শরীফ হুসাইন। সে খুবই ক্ষমতালিপ্সু ছিল। ইংরেজরা তাকে উস্কানি দিয়ে উসমানীদের থেকে আলাদা করে। ১৯১৬ খৃস্টাব্দে (১৩৩৪ হিঃ) ইউরোপের তিন প্রধান শক্তি রাশিয়া, ফ্রান্স ও বৃটেনের মধ্যে ‘‘সাইকস্তপাইকো’’ ও ‘‘সাজোনোভ’’ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির কথা ছিল উসমানী সাম্রাজ্যের যেসব এলাকা বিচ্ছিন্ন করা হবে সে সবকে এ তিন শক্তির ভেতর সমানভাবে বন্টন করে দিতে হবে। কিন্তু কিছুকাল পর বৃটেন এই চুক্তিকে সুয়েজ খালে স্বীয় আধিপত্যের বিরোধী হিসাবে দেখতে পায়। তাই ১৯১৭ সনে রাশিয়ার দুর্বলতা ও সেখানে সংঘটিত বিপ্লবের সুযোগ নিয়ে বৃটেন চুক্তি মেনে চলতে অস্বীকৃতি জানায় এবং ফিলিসি-কে নিজের তত্ত্বাবধানে গ্রহণ করে নেয়।
এসব পদক্ষেপ এমনি এক অবস্থায় গৃহীত হয় যখন উসমানী সাম্রাজ্যকে ছত্রভঙ্গ ও দুর্বল করার পথ হিসাবে সাম্রাজ্যবাদী বৃটেনের পক্ষ থেকে তীব্রভাবে জাতীয়তাবাদী চিন্তা প্রচলন ও শক্তিশালী করা হয়। ফলে বেশীর ভাগ ইসলামী দেশেই ক্রমশ জাতীয়তাবাদী চিন্তা দর্শন ইসলামী ঐতিহ্য ও আদর্শের স্থান দখল করে নেয়। আর এ জাতীয়তাবাদই তৎকালীন উপনিবেশবাদীদের নেতা বৃটেনের উপনিবেশবাদী নীতি অবস্থানের স্বার্থ মেটানোর মূল হাতিয়ারে পরিণত হয়। ফলে অনৈক্য সৃষ্টি এবং ইসলামী দেশসমূহ, বিশেষ করে উসমানী সাম্রাজ্যকে ভেঙ্গে তছনছ করার সামপ্রদায়িক ও বর্ণবাদী আন্দোলনসমূহের জন্ম হয়।
অথচ ঠিক এমনি সময় বৃটেনে বিশ্বের ইয়াহুদী জাতির ঐক্যের কুহেলিকাপূর্ণ আহবানের সূত্রপাত ঘটে যা কিনা ঐতিহাসিকভাবে ছিলো অসঙ্গতি পূর্ণ ও ভিত্তিহীন। বৃটিশ সরকার ইয়াহুদী বর্ণবাদী জাতীয়তার প্রচারণা শুরু করে। এতে করে কিছু সংখ্যক ইয়াহুদী একটি একক ইয়াহুদী জাতির চিন্তা ও তাদের জন্য একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার তৎপরতা শুরু করে। আর এহেন অপতৎপরতার প্রতি সাংঘাতিক শক্তি ও মদদ যোগায় বৃটিশ সরকার।
ওই ইয়াহুদী গোষ্ঠীটি ধনাট্য ইয়াহুদীদের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য সংগ্রহ শুরু করে দেয় এবং নিজেদের লক্ষ্য হাসিলের জন্য একটি দল গঠন করে। এরা ফিলিস্তিনের একটি পাহাড়ের নামে দেশটির নাম রাখে যায়ন (ুরড়হ)। এ যায়ন পাহাড়ের উপরই রয়েছে হযরত দাউদ ও হযরত সুলায়মান আলাইহিমুস সালামসহ বনি ইসরাইলের অনেক নবীর মাজার। ঊনবিংশ শতকের শেষ দিকে (১৮৯২-১৮৯৮ খৃঃ) জাতীয়তাবাদী ইয়াহুদীরা বিভিন্ন দেশের ইয়াহুদীদের ফিলিস্থিনে গমন ও অভিভাসন দানে তৎপরত হয়ে ওঠে। তবে ইয়াহুদী আলেমরা এ তৎপরতার হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যাবলী এবং উপনিবেশবাদীদের সাথে এ তৎপরতার যোগসূত্র আবিস্কার করতে পেরে বিরোধিতা করায় এ যায়নবাদী আন্দোলন ব্যর্থ হয়ে যায়। কিন্তু বিশ শতকের প্রথমদিকে ফিলিস্তিনের ওপর বৃটিশ উপনিবেশবাদীদের প্রভুত্বের সুযোগে বিশ্ব জুড়ে ইয়াহুদীদের সাথে বিরোধিতা ও এদের নিপীড়নের সমাধান হিসাবে সামনে একটি ইয়াহুদী রাস্ট্র প্রতিষ্ঠার ধুয়া তোলা হয়। কেননা যায়নবাদের লক্ষ্যই ছিল প্রাচীন ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা। বৃটেনও এ সময় এলাকাতে তার আধিপত্য অব্যাহত রাখার জন্য একটি ঘাটির অভাব বোধ করছিল।
যায়ন পার্টি এ পরিকল্পনার ব্যাপারে অন্যান্য ইয়াহুদী সংস্থার বিরোধিতার সম্মুখীন হলেও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে বসেছিল যারা বিরুদ্ধবাদী ওসব সংস্থার মুকাবিলা শুরু করে। এ দলটি প্রথম মহাযুদ্ধের সময় বৃটেন ও আমেরিকার কাছ থেকে এ প্রতিশ্রুতি আদায় করে যে, যুদ্ধ শেষে জার্মানীর মিত্র উসমানী সরকারের পরাজয় ঘটলে ফিলিস্তিনকে ইয়াহুদী রাষ্ট্রে পরিণত করতে হবে। কেননা প্রথম যুদ্ধের আগ পর্যন্ত বায়তুল মুকাদ্দাস সরকারীভাবে উসমানীদের হাতে ছিল। যায়নবাদীদের চেষ্টা ফলবতী হলো এবং এরা বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড বেলফোরের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। এরা আমেরিকাতে সেদেশের ব্যক্তিত্ববর্গের মনোযোগ আদায় করতে সক্ষম হয়।
শেষ পর্যন্ত ১৯১৭ খৃস্টাব্দে ফিলিস্তিন ভূখন্ডে ‘‘ইয়াহুদী জাতির কেন্দ্র’’ স্থাপনের বিষয়টি বৃটিশ মন্ত্রিসভায় স্থান পায়। ইংরেজদের অনুচর এবং মক্কা শরীফের গর্ভনর শরীফ হুসাইন এ ব্যাপারে বৃটিশ সরকারের কাছে ব্যাখ্যা দাবী করেন। বৃটিশ সরকারও জবাব দেয়, ফিলিস্থিনে ইয়াহুদীদের প্রত্যাগমনের সিদ্ধান্ত ফিলিস্তিনী জনগণের অধিকার ও স্বাধীনতার সাথে বিরোধপূর্ণ নয়। এ জবাবে ইসরাইল সরকার গঠনের কোন কথাই ওঠেনি। যুদ্ধের শেষ দিকে যায়নবাদী সংগঠনের অনুচরবাহিনী ফিলিস্তিনের কিছু অংশ দখল করে নিলে আরবদের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এর আগে থেকেই ফিলিস্থিনে ছোট ছোট গ্রুপে কলোনীবাসী হিসাবে ইয়াহুদীদের বসবাস করার সুযোগ দেয়া হয়। এরা স্থানীয় আরবদের কাছ থেকে ভূমি কেনা শুরু করে ও ইয়াহুদী কৃষি খামারের পত্তন ঘটায়।
১৯২০ সালে মিত্র শক্তি ও আন্তর্জাতিক সমাজ ফিলিস্তিনের অভিভাবকত্বকে আনুষ্ঠানিকভাবে বৃটিশ সরকারের হাতে ছেড়ে দেয় এবং সেখানে ইয়াহুদী জাতীয় কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে বেলফোর ঘোষণা বাস্তবায়নে সহায়তা করার দায়িত্ব অর্পণ করে। সে সময় ফিলিস্থিনে মাত্র পঞ্চাশ হাজার ইয়াহুদী ছিল। কিন্তু ইংরেজরা ফিলিস্তিনের শাসনভার একজন ইয়াহুদীর হাতে অর্পণ করায় তার সরকারের অধীনে সেখানে ইয়াহুদীদের আগমনের দরজা খুলে যায়। কিছুকালের মধ্যেই ইয়াহুদীদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে তা আরবদের বিরোধিতা ও বিদ্রোহের কারণ ঘটায়। বৃটিশ উপনিবেশ মন্ত্রী চার্চিল তখন বিদ্রোহ ঠেকানোর জন্যে ঘোষণা দেন যে, সমগ্র ফিলিস্তিনকে একটি ইয়াহুদী দেশে পরিণত করার ইচ্ছা বৃটেনের নেই। আর ইয়াহুদী জাতীয় কেন্দ্র স্থাপনের প্রয়োজন অনুপাতে এবং ফিলিস্তিনের অর্থনৈতিক শক্তির আওতায়ই কেবল ইয়াহুদী অভিভাসন অব্যাহত থাকবে।
ইংরেজদের সহায়তায় অতি দ্রুত ফিলিস্থিনে ইয়াহুদীদের বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, এমন কি সন্ত্রাসবাদী সংগঠন তৈরী হতে থাকে। সারা বিশ্বের ইয়াহুদী পুঁজিপতিরা এদের আর্থিক সাহায্য দিতে থাকে। সে সময় আরবরা ছিল ছত্রভঙ্গ, অসংহত ও বিচ্ছিন্ন। কেবল শ্লোগান ব্যতীত এরা ফিলিস্তিনীদের কোন সাহায্যই করেনি। ফিলিস্তিনের আরব ও খৃস্টান জনতা পারস্পরিক বিভেদ ভুলে গিয়ে অভিন্ন শত্রুর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হলো। ১৯২৯ সালের গ্রীস্মকালে একপক্ষে ফিলিস্তিনের আরব ও খৃস্টান জনতা এবং অন্যপক্ষে ইয়াহুদী মুজাহিরদের মাঝে প্রথম রক্তাক্ত সংঘর্ষ বাঁধে। ইয়াহুদী যায়নবাদীরা ও ইংরেজ সৈন্যরা মিলে ফিলিস্তিনের দিকে গুলী বর্ষণ করলে প্রায় ৩৫১ জন ফিলিস্তিনী শাহাদত বরণ করে এবং কিছু সংখ্যক আহত ও বন্দী হয়। এক প্রহসনমূলক বিচারে একদল ফিলিস্তিনীকে আজীবন কারাদন্ড কিংবা ফাঁসি দেয়া হয়। বিশের দশকের শেষ দিক থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত সময়ে শেখ ইযযাদ্দিন কাসসামের সশস্ত্র অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। তিনি বৃটিশ ও ইয়াহুদী বর্ণবাদী সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামেন। শেষ পর্যন্ত তিনি ও উনার বেশীর ভাগ সাথী শাহাদত বরণ করেন ও অবশিষ্টরা কারারুদ্ধ হন।
১৯৩৭ সালে আব্দুল কাদের হুসাইনী সংগ্রামের নেতৃত্ব হাতে নেন। তিনি বহু যুদ্ধের পর শেষ পর্যন্ত সঙ্গীসাথীসহ শাহাদত বরণ করেন। ১৯৪৪ সালে হাসান সালামা বৃটিশ ও যায়নবাদী যৌথ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের নেতৃত্ব দান করেন এবং কিছুকাল পর তিনি শাহাদত বরণ করেন। চল্লিশের দশক থেকে ফিলিস্তিন ইস্যু একটি আরব ইস্যুতে পরিণত হয় এবং আন্তর্জাতিক বিষয়াদির শীর্ষে স্থান লাভ করে। এ ধরনের একের পর এক সংগ্রাম ও আরবদের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার মুখে বৃটিশ সরকার বেপরোয়া ইয়াহুদী অভিভাসন সীমিত করতে বাধ্য হলে তা যায়নবাদীদের তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন হয়। ইয়াহুদী বর্ণবাদীরা এমন কি সন্ত্রাসবাদী কাজেও হাত দেয়।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে ফিলিস্থিনে মোটামুটি শান্তিপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করে। কিন্তু ১৯৪৮ সনের ১৪ই মে তারিখে বৃটিশ সরকার ফিলিস্থিনে তার অভিভাবকত্বের অসান ঘটিয়ে সৈন্যদের বের করে নিলে সেদিনই তেলআবীব শহরে ইয়াহুদী জাতীয় পরিষদ গঠিত হয় এবং ইসরাইল নামক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা দেয়। পূর্ব যোগাযোগ অনুসারে এর কয়েক ঘন্টা পরই আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান নয়া ইসরাইল সরকারকে স্বীকৃতি দান করে। ইংরেজরাও সেখান থেকে চলে যাওয়ার সময় তাদের যাবতীয় সাজসরঞ্জাম ইয়াহুদী যায়নবাদীদের হাতে তুলে দেয়। তখন থেকেই ফিলিস্তিনের ব্যাপারে জাতিসংঘ হস্তক্ষেপ শুরু করে। ফলে ফিলিসি-নিদের উপর ইয়াহুদীদের আগ্রাসন ঠেকানোর যাবতীয় প্রচেষ্টা নিস্ফল হয়।
দখলদার যায়নবাদী একের পর এক ফিলিস্তিনী শহর, গঞ্জ ও গ্রাম দখল এবং নিরস্ত্র অসহায় ফিলিস্তিনীদের ঘরবাড়ী থেকে উচ্ছেদ করা শুরু করে। দরিদ্র অসহায় ফিলিস্তিনী মুসলমানরা যায়নবাদীদের বাঁধা দিলে এই হায়েনার দল ১৯৪৮ সনের এপ্রিল মাসে দেইর ইয়াসিন ও কাফার কাসেম গ্রামে গণহত্যার তান্ডবলীলা চালায়। এতে নিরাশ্রয়ী বাস্তুহারা ফিলিস্তিনীদের ভেতর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং এরা প্রাণের ভয়ে জর্দান সীমান্তের ওপাড়ে পালিয়ে যায়। সে সময় আরবদেশগুলোর সৈন্য বাহিনী ময়দানে নামে। কিন্তু ইসরাইল, ইউরোপ ও আমেরিকার সরাসরি সমর্থন পেয়ে এবং সেখান থেকে বিরামহীনভাবে জঙ্গী বিমান ও সমরাষ্ট্র লাভ করে আরবদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়।
এ যুদ্ধে দশ লাখের অধিক আরব ফিলিস্তিনী বাস্তুহারা হয়। জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে তখন আরব ও ইয়াহুদী অঞ্চলে ভাগ করে দেয় এবং জেরুজালেমকে সরাসরি আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। কিন্তু ইসরাইল এ পরিকল্পনা মানেনি। অন্যদিকে ফিলিস্তিনীদের মাঝে বিভিন্ন গেরিলা গ্রুপ ও সংগঠন জন্ম নেয়। এরা ফিলিস্তিনীদের ন্যায়সঙ্গত স্বাভাবিক অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য গেরিলা যুদ্ধে নামে। ১৯৬৪ সালের ২৮ শে মে আল কুদস শহরে (বায়তুল মুকাদ্দাস) ফিলিস্তিন কংগ্রেস বসে এবং ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থায় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়া হয়। সাথে সাথে ফিলিস্তিন মুক্তিবাহিনীও গঠিত হয়। ফলে সংগ্রাম এক নয়া মোড় গ্রহন করে। এরপর থেকে হাজার হাজার ফিলিস্তিনী স্বদেশের মুক্তির পথে শাহাদত বরণ করতে থাকে। উল্লেখ করা আবশ্যক যে, তখনো পর্যন্ত বেপরোয়া ও বিরামহীন ইয়াহুদী আগমন ও অভিভাসন সত্ত্বেও আরব ও মুসলমানদের তুলনায় ইয়াহুদীরা ছিলো সংখ্যালঘু।
ছয় দিনের যুদ্ধ
১৯৬৭ সালের পাঁচই জুন ইসরাইল অতকির্তে মিশর, সিরিয়া ও জর্দানের বিমানবন্দগুলোতে হামলা চালিয়ে আরবদের সাথে যুদ্ধ শুরু করে। এ যুদ্ধে জর্দান নদীর পশ্চিম তীর, গাজা উপত্যকা, সিরিয়ার গোলান পার্বত্যাঞ্চল ও মিশরের সিনাই মরু এলাকা ইসরাইলের দখলে চলে যায়। আরব-ইসরাইলের এ যুদ্ধ ছয় দিনের যুদ্ধ বলে পরিচিত। এ যুদ্ধের পরাজয় থেকে আরবরা যে প্রত্যক্ষ শিক্ষা গ্রহন করলো তা হচ্ছে এরা ক্লাসিক যুদ্ধে ইসরাইলকে পরাজিত করতে পারবে না। কেননা ইসরাইলের হাতে রয়েছে ইউরোপ ও আমেরিকার অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র। তাই তারা গেরিলা গ্রুপগুলোকে শক্তিশালী করে সংগ্রামের সিদ্ধান্ত নেয়। এদিকে জাতিসংঘ ইশতেহার পাশ করে ইসরাইলকে অধিকৃত এলাকাসমূহ হতে পিছিয়ে আসার নির্দেশ দেয়। কিন্তু ইসরাইল তাতে মোটেও কর্ণপাত করেনি। উল্টো জর্দানের পরিচালনাধীনে ন্যস্ত বায়তুল মুকাদ্দাস শহর, বেথেলহাম (বায়তুল লাহম) এবং ২৭টি গ্রামকে জবরদখল পূর্বক ইসরাইলের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে ঘোষণা দেয়। ইসরাইল বায়তুল মুকাদ্দাসের তিন হাজার সংখ্যক ইয়াহুদী জনতাকে সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেয়ার লক্ষ্যে এদের সংখ্যা এক লাখ নব্বই হাজারে পৌঁছায়। ১৯৬৯ সালের ১১ই আগষ্ট তারিখে ইয়াহুদীরা মসজিদুল আকসায় আগুন ধরিয়ে দেয় এবং ঘোষণা দেয় যে, বৈদ্যুতিক বিভ্রাটের ফলেই এ ঘটনা ঘটে। অধিকতৃ অঞ্চলগুলোতে ইয়াহুদী শহর তৈরীতে দ্রুত হিড়িক পড়ে যায়। ইসরাইল বায়তুল মুকাদ্দাসের ইসলামী চেহারাকে ইয়াহুদী শহরের চেহেরায় পরিণত করার অপপ্রয়াসে লিপ্ত হয়।
ইয়াহুদী বর্ণবাদী সরকার পুরাকীর্তি, প্রাচীন শিলালিপি ও আম্বিয়া কেরাম এবং অতীত জাতিগুলোর নিদর্শনাদি খঁজে বের করার অজুহাতে মসজিদে ছাখরা, মসজিদে আকসা এবং আল কুদসের নিচে ও আশপাশে খনন কাজে হাত দেয় যাতে করে আরো কিছু সংখ্যক আরব বাশিন্দাকে সেখান থেকে বিতাড়ন পূর্বক ঐসব ঐতিহাসিক স্থাপনাকে ধ্বংস করতে ও নিজেদের খেয়াল খুশীমত গড়ে তুলতে পারে। ইসরাইল আমেরিকা, বৃটেন ও ইউরোপের মদদপুষ্ট হয়ে শক্তি নিয়ে অগ্রসর হতে থাকে এবং আরব বিশ্ব, এমন কি জাতিসংঘের বিরোধিতা সত্ত্বেও ইসরাইল সরকার তেলআবীবের পরিবর্তে বায়তুল মুকাদ্দাসকে (জেরুজালেম) তার রাজধানী হিসাবে ঘোষণা দেয়।
কারামা যুদ্ধ (১৯৬৮)
১৯৬৭ সনের জুন মাসে অনুষ্ঠিত ছয় দিনের যুদ্ধে আরবদের অবমাননাকর পরাজয়ের পর জর্দান, সিরিয়া ও লেবাননের শরণার্থী শিবিরগুলোতে প্রশিক্ষণ গ্রহণরত ফিলিস্তিনী প্রতিরোধ সংগঠনগুলো নিজেদের গেরিলা অভিযান তীব্রতর করে। জর্দানের রাজধানী আম্মানের পঁচিশ কিলোমিটার পশ্চিম জর্দান উপত্যকায় অবসি'ত কারামা শহরে বহু সংখ্যক ফিলিস্তিনী শরণার্থী অবস্থান নিয়েছিল। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর কারামা শহর যায়নবাদীদের যুদ্ধ বিরতি লাইন থেকে মাত্র চার কিলোমিটার দূরত্বে ও দুশমনের গুলীর আওতায় থাকে। কারামার জনসংখ্যা শরণার্থীদের আগমনে ২৫০০ থেকে বেড়ে দ্বিগুন হয়। আল ফাতাহ গেরিলা সংগঠন যায়নবাদীদের নিকটবর্তী হওয়ায় কারামাকে নিজের কেন্দ্রীয় ঘাঁটিতে পরিণত করে। তখন যায়নবাদী সরকারের যুদ্ধমন্ত্রী ঘোষণা দেয় যে, কারামা ফিলিস্তিনী প্রতিরোধের মূল ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে। ফিলিস্তিনীরাও ইয়াহুদী বর্ণবাদীদের হুমকির মুকাবিলায় শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেয়। ফিলিস্তিনীদের এ সিদ্ধানে-র আরেকটি ব্যাখ্যা ছিল এই যে, কারামায় প্রতিরোধ চালিয়ে জর্দান সরকারকেও বুঝিয়ে দেয়া হবে যে, কারামায় ফিলিস্তিনীদের খুন ঝরানো হলে সেখানে তাদের অবস্থান করা ও জর্দান উপত্যকায় গেরিলা যুদ্ধ ছড়িয়ে দেয়ার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে।
ইসরাইল বাহিনী আপাদমস্তক সজ্জিত হয়ে কারামার উপর আগ্রাসন চালায়। সেখানে তিন’শ ফিলিস্তিনী গেরিলার সাথে হাতাহাতি যুদ্ধে যায়নবাদী সৈন্যদের অনেকে নিহত হলে ইসরাইলী সৈন্যদের অনেকে নিহত হলে ইসরাইলী সৈন্যরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এ যুদ্ধ ফিলিস্তিনী জাতিকে বিজয় লাভের নয়া পথ ও উপায়ান্তর বাতলে দেয়। তখন থেকে বহু সংখ্যক ফিলিস্তিনী আল ফাতাহ গেরিলা সংগঠনে যোগদান শুরু করে।
কারামা যুদ্ধে ফিলিস্তিনী প্রতিরোধ সংগ্রামের প্রতি ব্যাপকতম জনসমর্থন অর্জিত হয়। আরব সরকারগুলো পর্যন্ত এদের সমর্থন দেয়, বিশেষতঃ জর্দানের সামরিক বাহিনী ফিলিস্তিনের সাহায্য করতে থাকে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ সহযোগিতা ছিল সাময়িক। ইসরাইলের পরবর্তী হুমকি-ধমকি ও ফিলিস্তিনীদের প্রতিরোধের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে গেরিলাদের সাথে জর্দান সরকারের দ্বন্দ্ব-সংঘাত প্রচন্ডতর হয়-যা শেষ পর্যন্ত ১৯৭০ সালের কালো সেপ্টেম্বরের রক্তাক্ত ঘটনার জন্ম দেয়। জর্দানী বাহিনী ফিলিস্তিনী গেরিলা যোদ্ধা ও জনতাকে পাইকারী হারে হত্যা করে।
রমজান যুদ্ধ (অক্টোবর, ১৯৭৩)১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাসে মিশরের সামরিক বাহিনী অতর্কিতভাবে আল্লাহু আকবার ধ্বনি দিয়ে সুয়েজ খাল অতিক্রম করে এবং অলঙঘনীয় বলে খ্যাত ইসরাইলের বারলেভ প্রতিরক্ষা লাইন ভেঙ্গে সিনাই মরুভুমি ও ইসরাইলের ভূখন্ডে ঢুকে পড়ে। পূর্বদিক থেকেও একই সময় সিরীয় বিমান বাহিনী ইসরাইলের উপর হামলা চালায় এবং যুদ্ধের প্রথম কয়েক দিনেই ইসরাইলের কয়েক ডজন বিমান ধ্বংসপ্রাপ্ত, হাজার হাজার ইসরাইলী সৈন্য নিহত কিংবা বন্দী হয় এবং ইসরাইলের অপরাজেয় হওয়ার রূপকথা শূন্যে মিলিয়ে যায়। কিন্তু যুদ্ধের পরবর্তী দিনগুলোতে আমেরিকা ও পাশ্চাত্যের দ্রুত সামরিক সহায়তায় ও সরাসরি অংশগ্রহনে যুদ্ধের গতি ইসরাইলের পক্ষে মোড় নেয়।
অন্যান্য আরব দেশ, মিশর ও সিরিয়াকে সাহায্য না করার একই সময় ইসরাইলী সামরিক বাহিনী হেলিবোর্ড মাধমে সুয়েজ খালের পশ্চিমে মিশরের অভ্যন্তরে একটি ছোট্ট এলাকায় সৈন্য নামিয়ে তা অবরোধ করতে সক্ষম হয়। শেষ পর্যন্ত কায়রো থেকে ৬০১ কিলোমিটার দূরে যুদ্ধাবসানের জন্য আলোচনা শুরু হয় এবং সন্ধি চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে যুদ্ধের অবসান ঘটে।
রমজান যুদ্ধের অবসান এবং তারও আগে মিশরের জাতীয় নেতা জামাল আবদুন নাসেরের মৃত্যু ঘটলে মিশরের প্রেসিডেন্ট পদে আনোয়ার সাদাত ক্ষমতাসীন হয়। আর তার হাতেই আমেরিকা ও পাশ্চত্যের সাথে আপোষের ধারা প্রবর্তিত হয়।
১৯৭৪ সালে পি এলও’র প্রতি স্বীকৃতি
১৯৭৪ সালে জাতিসংঘ ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থাকে (চখঙ) ফিলিস্তিন জনতার একমাত্র প্রতিনিধি হিসাবে স্বীকৃতি দেয় এবং ইয়াসির আরাফাত এক হাতে মেশিনগান ও অন্য হাতে শান্তির প্রতীক যয়তুনের শাখা নিয়ে জাতিসংঘের অধিবেশনে উপসি'ত হয়। তৃতীয় বিশ্বের ও প্রগতিশীল দেশসমূহের প্রতিনিধিরা তাকে বিপুল সংবর্ধনা দান করেন।
লেবাননে ফিলিস্তিনীদের সংঘর্ষ
১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জর্দান সরকার কর্তৃক ফিলিস্তিনী প্রতিরোধ আন্দোলন দমন হওয়ার পর লেবাননে ফিলিস্তিনী শরণার্থী শিবিরগুলো ইসরাইলের মদদপুষ্ট ফালাঞ্জীগোষ্ঠী ও ডানপন্থীদের হামলার শিকার হয়। প্রথমতঃ ১৯৭৫ সালের মে মাসে কাতায়েব পার্টির (খৃস্টান) ফালাঞ্জীরা আইনে রুমানাতে ফিলিস্তিন গেরিলা যোদ্ধা ও বেসামরিক শরণার্থীবাহী বাসের উপর গুলী চালায়। এতে কয়েক ডজন লোক শহীদ ও আহত হয়। এ সংঘর্ষ লেবাননের অন্যান্য এলাকাতেও ছড়িয়ে পড়ে, যার চূড়ান্ত পর্যায়ে তেল জেয়তার শরণার্থী শিবির অবরোধ করা হয়। কামান হামলার পাশাপাশি খাদ্যসামগ্রী ও ওষুধ-পত্রের অভাবে হাজার হাজার ফিলিস্তিন নিহত ও আহত হয়। তখন থেকেই লেবাননে গৃহযুদ্ধ চলতে থাকে যা লেবানন সমাজের রাজনৈতিক ও সরকারী কাঠামোতে ব্যাপক প্রভাব ফেলে।
ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি
ফিলিস্তিন বিপ্লবের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যা আরব-ইসরাইল সম্পর্কে নতুন মোড় সৃষ্টি করে, তাহলো ১৯৭৮ সালে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি স্বাক্ষর। জামাল আবদুন নাসেরের পর সত্তরের দশকের প্রথম দিক থেকে, বিশেষ করে রমজান যুদ্ধের অবসান ঘটার পর মিশর আপোষের পথ ধরে। ১৯৭২ সালে সাদাত মিশর থেকে সোভিয়েত সামরিক উপদেষ্টাদের বের করে দেয়। ১৯৭৫ সালে সে ইসরাইলের সাথে সিনাই চুক্তি সম্পাদন করে এবং শেষ পর্যন্ত ১৯৭৮ সালে আমেরিকার ক্যাম্প ডেভিড নামক স্থানে ইসরাইলী প্রধান মন্ত্রী মেনাখিম বেগীন ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট কার্টারের সাথে হাত মিলিয়ে সে ইসরাইলের সাথে শান্তি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। এভাবে মিশরই প্রথম আরব দেশ হিসাবে দখলদার ইসরাইলকে স্বীকৃতি দান করে আরব বিশ্বে অনৈক্য ও বিভেদের জন্ম দিলো। আর এ ঘটনাটি ঘটে ইসলামী বিপ্লব বিজয়ের প্রাক্কালে।
অতীতের ঘটনা প্রবাহ এবং ক্যাম্প ডেভিডের বিশ্বাসঘাতকতা যদিও আরব জনতা ও মুসলিম উম্মার মাঝে ব্যাপক হতাশা ও কিংকর্তব্যবিমূঢ়তার জন্ম দেয়, তথাপি ১৯৭৯ সালের ফ্রেরুয়ারী মাসে ইরানে ইসলামী বিপ্লবের বিজয় এবং এলাকায় পাশ্চাত্য স্বার্থের শক্তিশালীতম পাহাড়াদার ও ইসরাইলের বৃহত্তম পৃষ্ঠপোষক তথা শাহ সরকারের পতন যায়নবাদ বিরোধী সংগ্রামের দেহে নতুন প্রাণের সঞ্চার করে এবং লেবানন ও ফিলিস্থিনে অভূতপূর্ব উল্লাস উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে এ কারণে যে, ইসলামী বিপ্লবের শ্লোগান সমূহের পুরোভাগে ছিলো ‘আজ ইরান, কাল ফিলিস্তিন’ শ্লোগান।
লেবাননে ফিলিস্তিনদের উপর যায়নবাদী সৈন্যদের আগ্রাসন
১৯৮২ সালের জুন মাসে যায়নবাদী সরকার ফিলিস্তিন মুক্তিসংস্থাকে (পি এলও) নিশ্চিহ্ন করার জন্য লেবাননের উপর স্থল, জল ও বিমান পথে ব্যাপক আগ্রাসন চালায় । যায়নবাদীরা প্রথমে ঘোষণা দেয় যে, এদের অভিযান শুধুমাত্র ফিলিস্তিনদের বিরুদ্ধে সীমিত থাকবে এবং চল্লিশ থেকে বাহাত্তর ঘন্টা স্থায়ী হবে। লেবাননে মোতায়েন সিরীয় বাহিনীর উপর কোন ধরণের হামলা কিংবা লেবাননের এক ইঞ্চি জমি দখলের ইচ্ছেও এদের নেই। এছাড়া অভিযান শেষ হওয়ার সাথে সাথে এরা লেবাননের মাটি ত্যাগ করবে।
এসব দাবীর বরখেলাফ করে যায়নবাদীরা বেকা উপত্যকায় মোতায়েন সিরীয় ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটিগুলোতে আঘাত হানে এবং এদের অভিযান আশি দিন অব্যাহত থাকে। অন্যদিকে এ অভিযান চলাকালে আরবদেশ সমূহ ও সোভিয়েত রাশিয়া ফিলিস্তিনদের সহায়তাদানে উদাসীনতা দেখায়। অথচ যায়নবাদী ইসরাইলীরা সর্বোত্তম সুযোগ গ্রহণ করে। অর্থাৎ ইরান ও ইরাক যখন সার্বিক যুদ্ধে ব্যস্ত এবং এ কারণে এলাকার এতোদিনকার প্রথম ও কেন্দ্রিয় ইস্যু হিসেবে ফিলিস্তিন ইস্যু যখন দ্বিতীয় স্তরে স্থান পায় তখনি ফিলিস্তিনদের ধ্বংস করার কাজে হাত দেয়।
এ সময় আরব প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী ইরাকের প্রতি সর্মথন দানকে প্রধান ও এক নম্বর দায়িত্ব হিসাবে নিয়ে ফিলিস্তিন ও সিরিয়ার প্রতি সর্মথন দান থেকে বিরত থাকে। যায়নবাদীদের এ অভিযানের ফলে এবং পিএলও-এর অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষয়ী দ্বন্দ্বের কারণে ফিলিস্তিনরা বৈরুত ছেড়ে যেতে বাধ্য হয় এবং আটটি আরব দেশ ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। পিএলও-এর কেন্দ্রীয় দফতর তিউনেশিয়ায় স্থানাস্তর করা হয়। এ যুদ্ধ ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থার সামরিক ভিত্তিকেই কেবল র্দূবল করেনি বরং এদের হাত থেকে রাজনৈতিক তৎপরতা চালানোর ক্ষমতাও কেড়ে নেয় । এর ফলে কতিপয় ফিলিসি-ন নেতা আপোষের পথ অবলম্বন এবং মিশর ও জর্দানের নিকটবর্তী হওয়ার পথ ধরে।
এ যুদ্ধের আরো গুরুত্বপূর্ণতম ফল হচ্ছে ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থার (পিএলও) অভ্যন্তরে বিশেষ করে আল ফাতাহ গ্রুপের ভেতর মতভেদ তীব্রতর হওয়া। এই আল ফাতাহই ছিল পিএলও সংস্থা প্রতিরক্ষার অন্যতম প্রধান অংশীদার ও মেরুদন্ড। এ মতবিরোধ পিএলও-এর আনর্-জাতিক ভাবমূর্তিতে সাংঘাতিক আঘাত হানে।
পিএলও-র অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব আল ফাতাহের অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে বেকা উপত্যকায় ১৯৭৩ সালের ৯ মে তারিখে শুরু হয়। কর্ণেল আবুমুসা ও আবু সালেহ্ ছিলেন পিএলও-এর কেন্দ্রীয় কমিটি এবং আল ফাতাহের বিপ্লবী কাউন্সিলের সদস্য। তারা সিরিয়ার সমর্থন পেয়ে আরাফাতের বিরুদ্ধে অনাস্থা আনেন এবং আল্ ফাতাহের নীতিমালা পরিবর্তন ও লিবিয়া, সিরিয়া ও আলজেরিয়ার সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের দাবী জানান । এ অনাস্থার কারণে আরাফাতের বিরোধী ও সমর্থকদের মাঝে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের জন্ম দেয়। শেষ পর্যন্ত আরাফাত ও তার সমর্থকদের লেবানন থেকে বহিস্কৃত হতে হয়। এরা জাতিসংঘের পতাকাবাহী পাঁচটি গ্রীক জাহাজে চড়ে এবং ফরাসী নৌ-বাহিনীর পাহাড়ায় লেবাননের ত্রিপলী বন্দর, ইয়ামেন, তিউনেশিয়া ও আলজেরিয়ার ফথে রওনা হয়। আল ফাতাহের বিদ্রোহী গ্রুপ প্রথম থেকেই লিবিয়া ও সিরিয়া সমর্থক বামপন্থী গ্রুপগুলোর পৃষ্ঠপোষকতা পায়। আরাফাত বিরোধীদের প্রতি লিবিয়া ও সিরিয়ার সমর্থন থাকার ফলে এ দুই দেশ বিরোধী নীতি অবস্থানের অধিকারী জর্দান ও মিশরের দিকে আরাফাত পূর্বাপেক্ষা বেশী ঝুঁকে পড়ে। এরপর থেকে পিএলও-এর মধ্যে আবু মুসার নেতৃত্বে ফাতাহ ইন্তিফাদা নামক নয়া শাখার জন্ম হয়।
বৈরুতে আমেরিকা ও ফরাসী নৌ-সেনাদের ঘাঁটিতে বিষ্ফোরণ (১৯৮৩ সালের ২৩ শে অক্টোবর )
১৯৮২ সালের ৬জুনে লেবাননের মাটিতে ইসরাইলী সৈন্যদের আগ্রাসন এবং বৈরুত পর্যন্ত অগ্রসর হওয়ার ফলে লেবাননে আমেরিকা, ফ্রান্স ও ইতালীর বহুজাতিক বাহিনী আগমনের পটভূমি তৈরী হয়। যায়নবাদী আগ্রাসীরা তাদের অভিযানের প্রথম দিকে ঘোষণা দেয় যে, লেবাননের অভ্যন্তরে ৪০ থেকে ৪৫ কিলোমিটার গভীর পর্যন্ত একটি নিরাপত্তা এলাকা তৈরীই এ অভিযানের লক্ষ্য । কিন্তু পরে এরা বৈরুতে অবরুদ্ধ ফিলিস্তিন মুক্তিসংস্থার সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণ ও লেবানন থেকে পিএলওএর সম্পূর্ণ বহিস্কারের দাবী জানায়। এ দাবী পূরণের জন্য পশ্চিম বৈরুতের উপর বিরামহীনভাবে প্রচন্ড বোমাবর্ষণ চালাতে থাকে। এছাড়া সাবরা ও শাতিলা শরণার্থী শিবির হাজার হাজার ফিলিস্তিনীকে হত্যা করে।
শেষ অবধি লেবানন সরকার ও পিএলও ফিলিস্তিনী ইউনিটগুলোকে সরিয়ে নিতে বাধ্য হয় এবং এ সিদ্ধান্তও গৃহীত হয় যে, ফিলিস্তিনীদের অপসারণ পর্যবেক্ষণ ও তত্ত্বাবধান করার জন্য বহুজাতিক বাহিনী বৈরুতে অবস্থান নেবে। এ বহুজাতিক বাহিনীর সৈন্যরা হচ্ছে আমেরিকা ও ফ্রান্সের আটশ এবং ইতালীর চারশ সৈন্য। ১৯৮২ সালের ২১ আগষ্ট থেকে পয়লা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বহুজাতিক বাহিনী লেবানন থেকে পিএলও সৈন্যদের নির্বাসন তদারকী করে।
২৯ সেপ্টেম্বর বৈরুতে যে সব এলাকা ইসরাইল বাহিনী পরিত্যাগ করে সেখানে মার্কিনী সৈন্যদের প্রথম দলটি প্রবেশ করে বহুজাতিক নামক পশ্চিমা বাহিনী শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা, বিবদমান দলগুলোর মাঝে শান্তি আলোচনা এবং বৈরুতের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব অবসানের বাহানায় লেবাননে নিজেদের উপসি'তি অব্যাহত রাখতে থাকে। প্রকৃতপক্ষেএরা প্রগতিশীল ও ইসলামী দলগুলোকে ভয়ভীতি দেখিয়ে পদানত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়। ১৯৮৩ সালের ২৩ অক্টোবর বহুজাতিক বাহিনীর ঘাঁটিগুলো ইসলামী জিহাদ সংস্থার শাহাদতকামী অভিযানের শিকার হয়। বৈরুতেস্থ আমেরিকান নৌ-বাহিনীর ঘাঁটিতে গাড়ী বোমা বিষ্ফোরণের ছয় মিনিট পরই ফরাসী ছত্রী সেনাদের ঘাঁটি একই কায়দায় বিষ্ফোরিত হয়। এতে ২৪১ জন মার্কিন নৌ-সেনা ৫৮জন ফরাসী ছত্রী সেনা নিহত হয়। এ বিষ্ফোরণ ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর আমেরিকান সৈন্যদের উপর এবং আলজেরিয়ার মুক্তিযুদ্ধের পর ফরাসী সৈন্যদের উপর গুরুতর সামরিক ও রাজনৈতিক আঘাত বলে আভিহিত হয়। এতে বহুজাতিক বাহিনীর শান্তশওকত ও এদের সৃষ্ট ভয়ভীতি বরবাদ হওয়ার পাশাপাশি লেবানন ও ফিলিস্থিনে বিপ্লবী মুসলমানদের সংগ্রামী মনোবল প্রবল হয়ে ওঠে ।
শিবির যুদ্ধ
১৯৮৫ সালের ১৯মে থেকে ১৯৮৭ সালের প্রথম দিক পর্যন্ত প্রায় দেড় বছর ধরে লেবাননের শিয়া সংগঠন আমাল ও বৈরুতের শরণার্থী শিবিরের ফিলিস্তিনী গেরিলাদের ভেতর যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয় । একপক্ষ অন্য পক্ষের এলাকাসমূহ অবরোধ করে রাখে। এ র্দীঘ যুদ্ধ ফিলিস্তিনীদের ঐক্য ও বিভেদের উপর সুদূর প্রসারী প্রভাব ফেলে। লেবাননে ফিলিস্তিনীদের অবস্থান এবং সেখান থেকে ইসরাইলী বিরোধী অভিযান চালানার অজুহাতে ১৯৮২ সালে ইসরাইলের আগ্রাসনের পরিপেক্ষিতে আমাল সংগঠন চাচ্ছিল না যে, ফিলিস্তিনীরা লেবাননকে তাদের স্বদেশে পরিণত করে নিক। অন্যদিকে ফিলিস্তিনীরা বলতো, যদিও আমালের কথাই ঠিক তথাপি ফিলিস্তিনীদের সাহায্য করতে হবে যাতে তারা নিজ দেশে ফিরে যেতে পারে।
এসব বিতর্ক শেষ পর্যন্ত ফিলিস্তিনী গেরিলা সংগঠন ও শিয়াদের তৎকালীন বড় সংগঠন আমালের মাঝে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটায় যা প্রকৃতপক্ষে আল কুদস গ্রাসী ইসরাইলের স্বার্থকেই রক্ষা করে। এ যুদ্ধের ফলে আমালের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ফিলিস্তিনী গ্রুপের ভেতর অভিন্ন নীতি-অবস্থান গ্রহনের সুযোগ আসে। এদিকে লক্ষ্য রেখেই আল্ ফাতাহের নেতৃত্বের কঠোর বিরোধী ফাতাহ ইন্তিফাদা সংগঠন ঘোষণা দেয় যে, রাজনৈতিক কোণঠাসা অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্যই আরাফাত শিবির যুদ্ধের উস্কানি দিয়েছে। আমাল সংগঠনের ভেতরেও কার্যক্রমের বিশুদ্ধতা ও নেতৃত্বের নীতি অবস্থান প্রশ্নে সমালোচনা ও দ্বিধা দ্বন্দ্ব দেখা দেয় এবং বিভিন্ন শাখা, বিশেষ করে ইসরাইলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালনার লক্ষ্যে জিহাদী সংস্থাগুলোর জন্ম হয়।
আর এভাবেই আশির দশকের প্রথম থেকে লেবাননে সংঘটিত ঘটনাবলী সামগ্রিকভাবে ইসরাইল বিরোধী সংগ্রামী ফ্রন্টকে ভেজালমুক্ত হয়ে বিশুদ্ধতার দিকে এগিয়ে নেয়। ইরানের ইসলামী বিপ্লব থেকেও এ গতিধারাটি তীব্রভাবে প্রভাবিত হয়ে ইসরাইলের বিরুদ্ধে সংগ্রামে বিশ্বাসী মূল ও খাঁটি শক্তিগুলোকে নয়া শক্তি প্রদান করে। এ নবশক্তি ইসরাইলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করাকে ইসলামী ও ঈমানী দায়-দায়িত্ব বলে গ্রহণ করে নেয়। এরা আপোষ করার ঘোরতম বিরোধী হিসাবে এ পর্যন্ত আমেরিকা ও ইসরাইলের যাবতীয় লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও লালসা বাস্তবায়নকে গুরুতর সংকটের সম্মুখীন করেছে।
লেবাননে ‘‘হেযবুল্লাহ’’ সংগঠনের মতো সংগঠনগুলোর জন্ম ও শক্তি অর্জনই এ গতিধারার উজ্জ্বলতম নমুনা। এসব সংগঠনের বিরুদ্ধে দুশমনের প্রচারণা ও চক্রানে-র বিরামহীন প্রবল ঝড় উঠে যা শক্রপক্ষের শিবিরগুলোতে ভয়ভীতি ও ত্রাস গুরুতর আকার ধারণেরই প্রমাণ। এটা স্পষ্ট যে, আপোষকামী পরিকল্পনা ও চক্রান্তগুলো ক্ষণস্থায়ী সফলতার সম্ভবনারসমূহের কথা ধরে নিলেও এ ব্যাপারে নিশ্চয়তা লাভ করা যায় যে, লেবাননে ইসলামী প্রতিরোধ সংগ্রামের বীজ অঙ্কুরিত হয়ে গেছে এবং একইভাবে অধিকৃত ও এলাকাসমূহের যদি প্রতিরোধ সংগ্রাম অব্যাহত থাকে ও প্রয়োজনীয় শক্তি নিয়ে এগিয়ে যায় তাহলে দুশমনের পরাজয় সুনিশ্চিত।
ইন্তেফাদা তথা ফিলিস্তিনী গণঅভ্যুত্থানের উদ্ভব
এটা পরিস্কার যে, সাইয়েদ জামাললুদ্দীন আসাদাবাদীর (আফগানী) প্রচেষ্টায় ইসলামী দেশগুলোতে এবং ইরানে তামাক আন্দোলনের মাধ্যমে যে ইসলামী জাগরণের আন্দোলন সৃষ্টি হয় তা মিশরে মুহাম্মাদ আবদুহু ও সাইয়্যেদ কুতুবের মাধ্যমে নয়া পর্যায়ে উপনীত হয়। পাক ভারতে আল্লামা ইকবালের মতো মনীষীদের মাধ্যমে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনরূপে অব্যাহত থাকে, আলজেরিয়াতে ১৯৬২ সালের বিপ্লবের জন্ম দেয় এবং শেষ পর্যন্ত ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লবের বিজয় এই ইসলামী জাগরণের আন্দোলনকে জোরদার করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। তবে একটা বিষয় উল্লেখযোগ্য, আর তা হচ্ছে ইরানে ইসলামী বিপ্লব বিজয়ের আগে প্রায় দু’দশক যাবত ইসলামী দেশগুলোতে ইসলামী জাগরণের এই গণআন্দোলনের গতি মন'র হয়ে পড়ে।
কারণ একদিকে ইসলামী দেশগুলোতে স্বৈরাচারী সরকারগুলোর অসি-ত্ব মুসলমানদেরকে স্বৈরাচার বিরোধী রাজনৈতিক সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করতে এবং ইসলামী জাগরণের তাত্ত্বিক দিকটাকে স্লান করে দেখতে বাধ্য করে আর অন্যদিকে এ গতিধারাটি ইসলামী বিপ্লবপূর্ণ যুগে দারুনভাবে আরব জাতীয়তাবাদের শিকার হয়। খোদ এই আরব জাতীয়তাবাদও কতিপয় কারণের ফল যার মাঝে খৃষ্টান চিন্তাবিদ মাইকেল আফলাকের প্রতিষ্ঠিত ইরাক ও সিরিয়ার বাথ সমাজতন্ত্রী দল অন্যতম। মধ্যপ্রাচ্য এলাকায় এ দলটি ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক দল। এছাড়া ইসরাইল সরকারের উদ্ভব ও ইসরাইলের সাথে আরবদের যুদ্ধগুলো ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান হিসাবে এ ইস্যুকে আরবীয় ইস্যুতে পরিণত করে।
১৯৭৯ সালের প্রথমদিকে ইরানে ইসলামী বিপ্লব ইসলামী জাগরণী আন্দোলনে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনয়ন করে। কারণ এ বিপ্লব একদিকে এতে নয়া প্রাণস্পন্দন সঞ্চার করে এবং অন্যদিকে এতে রাজনৈতিক দিক-দর্শন ও সারবত্তা দান করে। কেননা এর আগ পর্যন্ত ইসলামী আন্দোলন ছিল সাংস্কৃতিক ও চিন্তাগত বিষয়, আত্মপরিচয়ে ফিরে আসার আহবান, ইসলামী পরিচয়ে প্রত্যাবর্তনের ডাক এবং ইসলামী উম্মার মাঝে অভিন্ন মূল্যবোধগুলোকে উজ্জীবিত করা।
এটা স্বাভাবিক ছিল যে, ইরানের ইসলামী বিপ্লবের আহবান মুসলমানদের নাড়া দেয়, তাদের আবেগ অনুভূতিকে চাঙ্গা করে তুলে এবং ইসলামী বিপ্লবের নেতা হযরত ইমাম খোমেনীর নীতি-অবস্থান ফিলিস্তিনী মুজাহিদ গোষ্ঠীসহ বিশ্বের সংগ্রামী মুসলমানদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। ইসলামী ঝোঁকপ্রবণতা পুনরুজ্জীবিত হলো। ফিলিস্তিনের জনগণ ইরানের ইসলামী বিপ্লবের আগেও মুসলমান ছিলেন, কিন্তু তাদেরকে সংঘবদ্ধ ও সংহত করার রশিটি ছিল আরব জাতীয়তাবাদ। ইসলাম ছিল দ্বিতীয় অবস্থানে। এ কারণেই ফিলিস্তিনীরা ইসলামী, খৃষ্টীয় ও সাম্রাজ্যবাদী বিভিন্ন মতাদর্শ নিয়ে এক এক গ্রুপ বা সংগঠনে সংঘবদ্ধ হতো। ইরানে ইসলামী বিপ্লব বিজয়ের পর একতা ও বিজয়ের জন্য ইসলামের শক্তি-সামর্থ্য ও সম্পর্কে চিন্তাদর্শন শক্তিলাভ করে এবং মুসলমান সংগ্রামীদের মনোযোগ ইসলামের দিকে আকৃষ্ট হয়।
ইরানের ইসলামী বিপ্লব ও ফিলিস্তিনের মাঝে সম্পর্ক বিপ্লব বিজয়ের বহু আগেই ইসরাইল বিরোধী অভিন্ন ফ্রন্টে গড়ে ওঠে। ইরানের গেরিলা যোদ্ধারা শাহের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে ফিলিস্তিনী শিবিরগুলোতে গমন করতো ও শিক্ষা নিতো। এ সুদৃঢ় সম্পর্ক বহু বছর আগ থেকেই গড়ে ওঠে। তখনি হযরত ইমাম খোমেনী খুমস, যাকাত ও অন্যান্য ইসলামী অর্থ তহবিলের এক তৃতীয়াংশ অর্থ ফিলিস্তিনী সংগ্রাম অব্যাহত রাখার পথে ব্যয় করার অনুমতি দান করেছিলেন। ১৯৭৮ সালে ইসলামী বিপ্লবের গতিধারা তুঙ্গে ওঠার সময় ‘‘আজ ইরান কাল ফিলিস্তিন’’ শ্লোগান যায়নবাদীদের ভীতসন্ত্রস্ত ও ফিলিস্তিনীদের আশান্বিত করে তোলে। এ ব্যাপারে ফিলিস্তিনী নেতৃবৃন্দ, বিশেষ করে ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থার নেতাদের বক্তব্য ও অভিমতই সবচে’ বড় প্রমাণ। ইসলামী বিপ্লব ও অভিমতই সবচেয়ে বড় প্রমান। ইসলামী বিপ্লব ও ইমাম খোমেনী সম্পর্কে বিপ্লবের প্রথম বছরগুলোতে তাদের উল্লাস ও উচ্ছাস দেশী-বিদেশী পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। উদাহরণ হিসাবে ছহিফায়ে নূর গ্রনে'র পঞ্চম খন্ডে ইমাম খোমেনীর সাথে ফিলিস্তিনী নেতাদের কথোপকথনের কথা উল্লেখ করা যায়।
ইসরাইলের সাথে সংগ্রাম একচেটিয়া ইরানের ইসলামী বিপ্লবের ব্যাপার ছিল না। বিপ্লবের আগে ও অধুনালুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে প্রাচ্য ব্লক ও প্রগতিশীল দেশগুলো বাহ্যতঃ ফিলিস্তিনীদের পৃষ্ঠপোষক ছিল। তবে এসব পৃষ্ঠপোষকতার কারণ ছিল আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও প্রতিযোগিতা কিংবা সর্বোত্তম পর্যায়ে ফিলিস্তিনী জাতির বেঁচে থাকার অধিকারে বিশ্বাস। কিন্তু এসব শক্তি ও দেশের কোন একটিও ইসরাইলের অসি-ত্ব বিরোধী ছিল না বরং একে স্বীকার করে নিয়েছিল। শুধু একটি আগ্রাসী দেশ হিসাবেই এর সাথে সংগ্রাম করতো। অথচ ইরানের ইসলামী বিপ্লব ও ইমাম খোমেনী একটি দেশ হিসাবে যায়নবাদী ইয়াহুদী রাষ্ট্রটির অসি-ত্বকেই অস্বীকার করেছেন এবং একে দখলদার ও যায়নবাদী সরকারের যে কোন ধরণের টিকে থাকেই ইসলামী জাহানে সকল ফেৎনা -ফাসাদ অব্যাহত থাকার কারণ বলে অভিহিত করেন। এ চিন্তা -দর্শনই ফিলিসি'নীদের মাঝে জাতীয় ও দীনী গৌরববোধ এবং ইসলামী চেতনা ও জাগরণকে তুঙ্গে ওঠার আর ইসরাইল ও তার মুরুব্বীদের ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলে।
ইসলামী জাগরণেরই আকারে অংশ ইন্তিফাদা
১৯৮৭ সালে এপ্রিলে আম্মানে আরব শীর্ষ সম্মেলন বসে এবং নজীর-বিহীনভাবে এ সম্মেলন যায়নবাদী সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালানোর ক্ষেত্রে ন্যূনতম নীতি-অবস্থানও গ্রহণ করেনি। সম্মেলনের সকল মনোযোগই নিবদ্ধ ছিল ইরান ও ইরাকের যুদ্ধের দিকে এবং সামগ্রিকভাবে এ সম্মেলন ক্যাম্প ডেভিড লাইন ধরে এগিয়ে যায়।এদিকে ফিলিস্তিনী জাতি বছরের পর বছর অপেক্ষা করছিল যে, আরব জগত তাদেরকে বাস্তুহারা অবস্থা থেকে নাজাত দেবে । বিশেষত অধিকৃত ফিলিস্থিনে বসবাসরত ফিলিস্তিনী জনগণ তাকিয়ে ছিল আরব সরকারগুলোর দিকে।
এই মজলুম জাতি ফিলিস্তিনী দল,গ্রুপ ও সংগঠনগুলোর আত্মবিস্মৃতি, ভোগ বিলাস, বিভেদ, অনৈক্য ও দল ভাঙ্গাভাঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে এবং ফিলিস্তিনী জনতার দুর্দশাগ্রস্থ অবস্থার প্রতি আরব সরকারগুলোর প্রকাশ্য উদাসীনতা ও অবহেলা প্রত্যক্ষ করে আরব জাতীয়তাবাদী চিন্তাদর্শনের কার্যকারিতা এবং সরকারগুলোর পৃষ্ঠাপোষকতা ও সর্মথন সম্পর্কে একেবারে সকল আশা-ভরসার অবসান ঘটায়। অন্যদিকে ইসলামের উপর আশা-ভরসা স্থাপন ও আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে ওঠে, বিশেষত ইরানে ইসলামী বিপ্লবের বিজয় থেকে তারা শিক্ষা গ্রহন করে।
আর এ ঠিক এসময়ই মক্কা শরীফে বায়তুল্লাহ আল হারামের মেহমান ইরানী হাজীদের পাইকারী হারে হত্যা করে সউদী শাসকগোষ্ঠী। এ রক্তাক্ত পাশবিক ঘটনায় চার শতাধিক হাজী মুশরিকদের সাথে বারায়াত ঘোষণা (সম্পর্কচ্ছেদের) এবং আমেরিকা ও ইসরাইল মুর্দাবাদ শ্লোগান দানের অপরাধে শাহাদত বরণ করেন। এদের ভেতর প্রায় দশজনের মতো হাজী ছিলেন অধিকৃত অঞ্চলের ফিলিস্তিনী। এই শহীদের জানাযা মিছিল ও শোকানুষ্ঠান অধিকৃত ফিলিস্তিনের রামাল্লাহ ও আলখলিল শহরসহ বিভিন্ন এলাকায় অনুষ্ঠিত হয়। এ সমস্ত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৮৭ সালের হেমন্তকালে অধিকৃত ফিলিস্তিনের অধিবাসীরা ইসরাইলের বিরুদ্ধে সংগ্রামের নয়া ধারা ও গণঅভ্যুাত্থানের সূচনা ঘটায় -যার নাম দেয়া হয় ইন্তিফাদা। ইন্তিফাদার অর্থ নাড়া দেয়া, নড়ে ওঠা, ঝাঁকুনি দেয়া। পাখীরা যেমন গোসল সেরে ভেজা শরীররটাকে হালকা করা ও আকাশে ওড়ার জন্য পাখা ঝাঁপটায় তেমনি এ ধরণের নাড়াকে বলে ইন্তিফাদা । ইন্তিফাদা ভেজালকে দূর করে খাঁটি হওয়ার গণঅভ্যুত্থান যাতে বিজয়ের আকাশপানে জনগণ পাখা মেলতে পারে। ইন্তিফাদার আগপর্যন্ত সকল আন্দোলন ও অভ্যুত্থানই ছিল বিশেষ কোন দল বা গ্রুপের সাথে সংশ্লিষ্ট । যেমন ‘ফাতাহ’ আন্দোলন’ যা ১৯৮৩ সালের মে মাসে আরাফাতের নেতৃত্বোধীন আল্ ফাতাহ থেকে আলাদা হয়ে যায় । কিন্তু এবার (১৯৮৭) এই ইন্তিফাদার আগে বা পরে কোন বিশেষণ যুক্ত হয়নি। এই ইন্তিফাদা আন্দোলন ছিল গণপ্রতিবাদ বা গণঅভ্যুত্থান । ফিলিস্তিন দখলদারী অব্যাহত রাখার প্রতিবাদ এই ইন্তিফাদার লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও ফলাফল হচ্ছে এরূপঃ
১. বিস্মৃতির আঁস্তাকুড় থেকে ফিলিস্তিন ইস্যুকে বের করা।
২. বিশ্ব জনমতের দৃষ্টি আকর্ষণ।
৩. এলাকাব্যাপী ইসলামী আন্দোলনের উত্তাল তরঙ্গের সাথে ইন্তিফাদাকে সমম্বিত করা যা ইন্তিফাদার চেহারাই সবিশেষ রূপ দান করে।
৪. ফিসি-ন সমস্যা সমাধানকে জরুরী পরিকল্পনা হিসাবে উপস্থান।
৫. ফিলিস্তিন ইস্যুর সাথে পশ্চিম ইউরোপকে ঘনিষ্ঠ করা।
৬. এমন কি আমেরিকা ও ইয়াহুদীদের মনেও ইসরাইলের রাজনৈতিক সঠিকতা সম্পর্কে সন্দেহ সংশয় সৃষ্টি করা। এর ফলে অনেক ইয়াহুদী এ মতে বিশ্বাসী হয় যে, ইসরাইলের চেহারাকে আরো নিন্দনীয় (গণআন্দোলন ও যায়নবাদী সৈন্যদের গণনির্যাতন ও দমনাভিযান) হওয়া থেকে ফিরিয়ে রাখতে হলে ফিলিস্তিনীদের কিছু সুযোগ -সুবিধা দেয়া আবশ্যক।
৭. যায়নবাদীদের অস্তিত্বের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকে হুমকিপূর্ণ করা।
৮. ফিলিস্তিনীগ্রুপগুলোর অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও মতভেদকে ম্লান করে দেয়া এবং সরকারগুলো ও আন্তর্জাতিক সমাজকে জনমতের অনুসারী করা -যারা এতোদিন নিজ নিজ স্বার্থে ফিলিস্তিন ইস্যুকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে আসছিল। ফিলিস্তিন জবর দখল এবং যায়নবাদী ইয়াহুদী সরকার প্রতিষ্ঠার চল্লিশ বছরেরও বেশী পর ইন্তিফাদার ফলে এই প্রথম ফিলিস্তিনী জনগন আক্রমণাত্মক ও ইসরাইলীরা আত্মরক্ষামূলক ভূমিকায় নামে।
গাজা-আরিহা আপোষদফা
ইন্তিফাদা আন্দোলন জন্ম নেয়াটা একদিকে শরণার্থী ফিলিস্তিনীদের মাঝে আশা-ভরসার আলোকচ্ছটা দেখা দেয় এবং অন্যদিকে ইসরাইল গুরুতরভাবে বিপদ অনুভব করে। একারণেই দখলদার সরকার বেকায়দায় পড়ে গিয়ে আপোষের জন্য তৈরী হয়। অথচ এতোদিন যাবত ফিলিস্তিনীদের ন্যূনতম ও নামকা ওয়াসে- স্বীকৃত অধিকারসম্বলিত যাবতীয় ইশতেহার ও পরিকল্পনাকেও ইসরাইলী যায়নবাদীরা শক্ত হাতে প্রত্যাখ্যান করে এসেছে এবং নিরাপত্তা পরিষদের ২৪২ ও ৩৩৮ নম্বর ইশতেহারকে অস্বীকার করেছে। রিগান শান্তি পরিকল্পনাসহ এ ধরনের বহু পরিকল্পনাকেই ইসরাইল পদতলে পিষ্ট করেছে। মূলত যে কোন রাজনৈতিক সমাধান প্রত্যাখানের পেছনে যে কারণটি নিহিত ছিল তা হচ্ছে যায়নবাদী ইয়াহুদীরা ফিলিস্তিন নামক কোন জাতির ঐতিহাসিক পরিচয়কেই ভিত্তিহীন বলে মনে করতো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইন্তিফাদার আতঙ্কে আমেরিকা ও ইসরাইল ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা পিএলও’র সাথে আলোচনায় বসতে বাধ্য হয়। সোভিয়েত রাশিয়ার পতন এবং একমুখী বিশ্ব ব্লক সৃষ্টি হওয়ার কারণেও আমেরিকা চাচ্ছিল যত দ্রুত সম্ভব সঙ্কটের কেন্দ্রগুলো বিশেষ করে বৈশ্বিক বিপদাপদের উৎস মধ্যপ্রাচ্যের অশান্তি ও সংকটের আগুনকে নিয়ন্ত্রণ করতে ও নিভিয়ে ফেলতে। কেননা এতে করে ইউরোপ ও জাপানের প্রভাব, এমন কি ইসলামপন্থী আন্দোলনকে ঠেকাতে ও নিশিহ্ন করতে পারবে।
এদিকে ফিলিস্তিনী আপোষকামী মহলও ইন্তিফাদাকে নিজেদের হাতে আলোচনায় দরকষাকষি ও সুবিধা আদায়ের ধারালো অস্ত্র মনে করে ফল ভোগের জন্যে আপোষের আলোচনায় অবতীর্ণ হয়।
১৯৯৩ খৃস্টাব্দের নয়ই সেপ্টেম্বর ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থার চেয়ারম্যান হিসাবে ইয়াসের আরাফাত আইজাক রাবিনের কাছে লিখিত এক পত্রে ইসরাইলের অসি-ত্ব স্বীকার করে নেয় এবং ইসরাইলকে স্বীকৃতি দানমূলক সকল আন্তর্জাতিক ইশতেহার ও বিধি মেনে নেয়বার ঘোষণা দান করে। এছাড়া পিএলও সনদের যে অংশে ইসরাইলের অস্তিত্ব অস্বীকার করা হয়েছিল তা বাতিল বলে ঘোষণা দেয়া হয়। আইজাক রবিনও একই দিনে জবাবী পত্রে ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থাকে ফিলিস্তিনী জনতার প্রতিনিধি হিসাবে স্বীকৃতি দেয় এবং এর সাথে আলোচনার বিষয়টি ইসরাইলী ক্যাবিনেটে অনুমোদন করিয়ে নেয়। ইয়াসির আরাফাত ও আইজাক রাবিন কতিপয় আলোচনার পর সতেরো দফাবিশিষ্ট এক খসড়া সমঝোতাপত্রে স্বাক্ষর করে। এ সমঝোতায় জর্দান নদীর পশ্চিম তীরের কিছু এলাকা (আরিহা) ও গাজা অঞ্চলের উপর ফিলিস্তিনীদের স্বায়ওশাসনকে মেনে নেয়া হয়।
আমেরিকা ও ইসরাইল কর্তৃক এ চুক্তি মেনে নেয়ার আসল মতলব ছিল ফিলিস্তিনীদের ভেতর ফাটল ধরানো এবং ইন্তিফাদার বিপ্লবী আগুনকে ফিলিস্তিনীদের দিয়েই নিভিয়ে দেয়া। এ আপোষ সমঝোতার আরেকটি ফল এই হয়েছে যে, প্রতিক্রিয়াশীল আরব সরকারগুলো কর্তৃক ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়ার পথে বিদ্যমান সকল বাধা-বিঘ্ন সরিয়ে রাস্তা মসৃন করা। এরা ইসরাইলকে এলাকায় একটি আইনানুগ ঘাঁটি হিসাবে গ্রহণ করে নিয়েিছল। ইসরাইলের পক্ষ থেকে এ চুক্তি মেনে নেয়াটা এক ধরনের পশ্চাদপসারণই ছিল। এর আসল কারণ ইন্তিফাদার বিপদ সম্পর্কে ইসরাইলীদের ভীষণ ভয় ও উদ্বেগ। তবে নিশ্চিত করেই বলা যায়, এ সমঝোতা ফিলিস্তিনী জাতির সংগ্রামের সুমহান লক্ষ্য-আদর্শ থেকে অনেক ব্যবধান রয়েছে।
ইসরাইলকে স্বীকৃতি দান ভবিষ্যত মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চল ও মুসলিম উম্মার জন্যে দারুন বিপর্যয় ডেকে আনবে। এ অপরাধের দায়-দায়িত্ব কেবল আরাফাত ও পিএলও’র ঘাড়েই বর্তাবে না। যখন এ সমঝোতার প্রতি ব্যাপক ও গভীর দৃষ্টিকোণ থেকে তাকাবো এবং ইমাম খোমেনীর চিন্তা-দর্শনের আলোকে বিচার করবো তখন দেখতে পাবো যে, এ গুনাহ ও অপরাধের দায়-দায়িত্ব সকল ইসলামী সরকারের ঘাড়েই বর্তিয়েছে। কেননা এরা সবাই এ ধরনের যিল্লতিপূর্ণ পরিসি'তি সৃষ্টির জন্যে দায়ী।
যা হোক এই আপোষকামী নয়া তৎপরতার ফলাফল ও ভাগ্য সম্পর্কে চূড়ান্তভাবে কিছু বলা যদিও অনেক সময়ের দরকার এবং আগামী বছরগুলোই বাস্তবতাকে তুলে ধরবে, তথাপি একথা বলা যায় যে, ফিলিস্থিনে প্রতিরোধের লীজ তার ইসলামী আকিদা বিশ্বাসগত উর্বর ক্ষেত্র খুঁজে পেয়েছে এবং ফিলিস্তিনী সাধারণ মুসলমান জনতার ঈমান ও আদর্শ এমনি এক ফল ধারায় পরিণত হয়েছে যে, তা প্রতিরোধের বীজ ও অঙ্কুরকে অবারিত পানি দিয়ে বড় করার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। আর তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাশা করা যায় যে, প্রতিরোধ ও আন্দোলনের এক বিশালদেহী চিরসবুজ বৃক্ষ তার জটাজাল বিস্তার করে মাথা তুলে চিরন্তন হয়ে দাঁড়াবে। এর সুস্পষ্ট লক্ষন ও নমুনা অত্যন্ত পরিস্কার। আর এটাই সেই ভবিষ্যত ইমাম খোমেনী যার প্রতীক্ষা করে গেছেন এবং উনার সমগ্র জীবন ও সংগ্রামব্যাপী এর বাস্তবায়ন দেখার জন্যে দুঃখ-কষ্ট সয়ে গেছেন এবং দৃঢ় পদক্ষেপ নিয়েছেন।
ইরানের ইসলামী বিপ্লবের সাথে ইন্তিফাদার তুলনা
ইন্তিফাদা আন্দোলন অনেক দিক দিয়েই ইরানের ইসলামী বিপ্লবের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ, বিশেষত কোন গ্রুপ বা সংগঠনের উপরই নির্ভরশীল নয়। ইরানের ইসলামী বিপ্লবের একটি বৈশিষ্ট্য এই ছিল যে, বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার আগ পর্যন্ত ইসলামী, অনৈসলামী, ও জাতীয়তাবাদী বহু দল ও গ্রুপ এবং া বিভিন্ন চিন্তা -দর্শনের লোকেরা আলাদা ভাবে শাহের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতো এবং সবাই ভবিষ্যত বিপ্লবকে নিজ নিজ সংগঠনের বলে মনে করতো। ১৯৭৭ সালের ৭ জানুয়ারী দৈনিক ইত্তেলায়াত পত্রিকায় ইমাম খোমেনী সম্পর্কে অবমাননাকর নিবদ্ধ ছাপা হলে এর প্রতিবাদে কোম শহরের একদল লোক শাহাদতবরণ করে। শহীদের স্মরণে তেহরান, তাবরিজ ও অন্যান্য শহরে সাত দিনের ও চল্লিশার অনুষ্ঠানাদি একের পর এক অনুষ্ঠিত হতে থাকে।
এসবের প্রতিটি অনুষ্ঠানেই সংঘর্ষ ও কিছু লোকের শাহাদতবরণ এবং পুনরায় তাঁদের চল্লিশা পালন একের পর এক অব্যাহত থাকে। ১৯৮৭ সালের শেষ পাঁচ মাসে ইরানের জনগণের অভ্যুত্থান সর্বব্যাপী রূপ ধারণ করে। তখন সকল রাজনৈতিক দল তথা মার্ক্সবাদী, জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী গ্রুপ-সংগঠন পর পর মতাদর্শ ও পথ ছেড়ে গণ আন্দোলন ও অভ্যুত্থানকে অনুসরণ করতে থাকে। কেননা কোন সংগঠনই কখনো সাংগঠনিক পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এ ধরণের গণঅভ্যুত্থানের প্রত্যাশা করেনি।
সকল দল ও গ্রুপ জনগণের কাতারে এসে যোগ দেয়। বিভিন্ন ব্যক্তিত্বের ছবি ও প্রতিকৃতি গণমিছিলে শোভা পেতে থাকে। কিন্তু সে সময় যে বিষয়টি জনগণের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং যা সকল জনতাকে দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ করে তা হলো একক লক্ষ্য অর্থাৎ শাহ ও তার উচ্ছেদ ঘটানো। জনগণের সকল শ্লোগানই ছিলো ইসলামমুখী ও ইসলামের জন্য আন্দোলন। কেননা ইসলামই ইরানের বেশীর ভাগ মানুষের ধর্ম। ইন্তিফাদা আন্দোলনও ঠিক একই বৈশিষ্ট্যের অধিকারী।
বর্তমানে ইন্তিফাদা সম্পর্কে নানা ধরণের দৃষ্টিভঙ্গি বিরাজমান। তবে যে বিষয়টি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বলা যায় তা হচ্ছে এই যে, ইন্তিফাদার গণমুখিতাও স্বতঃসফ'র্ততা ।আর ইসলাম হচ্ছে এর প্রাণশক্তি। এ বিষয়টিকেই ইসরাইল ভয় পাচ্ছে।
এ ধারণার ফলশ্রুতিই হচ্ছে ইন্তিফাদার প্রথম দিকে শেখ আহম্মদ ইয়াসিনকে গ্রেফতার ও কারারুদ্ধকরণ । ইন্তিফাদাকে নির্মূল করার জন্যই ১৯৯২ সালে নভেম্বরে চার’শ পনেরো (৪১৫) জন ফিলিস্তিনী সংগ্রামীকে অধিকৃত এলাকা থেকে বহিষকৃত করা হয়। এরা সবাই নিষ্ঠাবান মুসলমান ও হামাস সংগঠনের সমর্থক । এত্মাই একদিকে প্রমাণ করে যে, ইন্তিফাদার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ইসলামী এবং অন্যদিকে গণমুখী যা কোন বিশেষ দল বা সংগঠন, এমন কি হামাসেরও সদস্য নয়। এর প্রমাণ হলো এই যে, যায়নবাদী সরকার এদেরকে গণঅভ্যুত্থানের মূল চালিকাশক্তি হিসাবে বহিষকৃত করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইন্তিফাদা স্থগিত থাকেনি। এর কিছুদিন পরই অধিকৃত অঞ্চলের তিন শতাধিক অধিবাসী যায়নবাদী সৈন্যদের সাথে সংর্ঘর্ষে শহীদ ও আহত হয়। এ বিষয়টি প্রমাণ করে যে, ইন্তিফাদা আন্দোলন বিশেষ কোন দলের বা সংগঠনের নয়, বরং এর নেতৃত্ব ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে।
ইন্তিফাদা গণঅভ্যুত্থানের হঠাৎ করে উদ্ভভ এবং এ পর্যন্ত অব্যাহত থাকা প্রমাণ দিচ্ছে যে, যদিও বা ব্যক্তিবর্গ বা সংগঠন বিশেষ এই গণঅভ্যুত্থানের সূচনায় ভূমিকা পালন করেছে, তথাপি আন্দোলনের স্বতঃস্ফূর্ততায় এতে কোন ক্ষতি হয়নি। ইন্তিফাদার কোন কেন্দ্রিীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব নেই এবং কোন বিশেষ সংগঠনই এর স্নায়ু নিয়ন্ত্রণ করে না, বরং সকল সংগঠনই এর অনুসরণকারী ও সমর্থক এবং সবারই চেষ্টা ইন্তিফাদায় সাধ্যানুসারে অংশ নেয়া ও পরিকল্পনা দেয়া।
ফিলিস্তিনী সংগঠনগুলোর প্রতি এমনভাবে কথা বলে যেনো ইন্তিফাদার নেতৃত্ব তাদেরই হাতে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, এসব সংগঠনের বেশীর ভাগই ফিলিস্তিনের বাইরে তিউনেশিয়ায়, সিরিয়ায়, জর্দানে বা অন্যত্র অবস্থান করছে। ফিলিস্তিনের বাশিন্দারা ওসব সংগঠনের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে এবং অভিন্ন উদ্দেশ্যে তথা অধিকৃত এলাকাগুলোর মুক্তির জন্য কাজ করে যায়। কিন্তু এমন নয় যে, যদি এসব সংগঠনের সকলেও যদি হাত গুটিয়ে নেয় তাহলে ইন্তিফাদাও শেষ হয়ে যাবে। ইরানের ইসলামী বিপ্লবের সাথে ইন্তিফাদার আরেকটি সাদৃশ্য [পাশ্চাত্য বিশেষ করে আমেরিকার এই বাড়াবাড়িপূর্ণ প্রচারণা যে, ইন্তিফাদা ইরানের ইসলামী বিপ্লবকেই আদর্শ হিসাবে অনুসরণ করেছে এবং উভয়ের মধ্যে সাদৃশ্য বিরাজমান, তা অবশ্য ওদের নোংরামী উদ্দেশ্য প্রণোদিত বৈ অন্য কিছু নয়। ওরা ইন্তিফাদার মৌলিকত্বকে বিকৃত করে দেখানো ছাড়াও ইসলামী ঝোঁকপ্রবণতার বিরুদ্ধে কঠোর আচারণ প্রদর্শনের বাহানা খোঁজ করছে। বিশেষতঃ এ কারনে যে, বিশ্ব ও ইউরোপীয় জনমত যায়নবাদীদের এতোসব নিষ্ঠুরতাকে মেনে নিতে তৈরী নয় বলেই এ ধরনের প্রচরণা চালিয়ে ইন্তিফাদাকে দমনের জন্যে ইসরাইলীদের হাতে সুযোগ তুলে দিচ্ছে যাতে পশ্চিমারা বলতে পারে যে, যদি ফিলিস্তিনীদের দমন না করি তাহলে সেখানে ইসলামী মৌলবাদ বিকাশের ঘাঁটি তৈরী হবে এবং আন্দালুসিয়ায় (স্পেনে) বিপর্যয়েরই (মুসলমানদের বিজয়) পুনরাবৃত্তি ঘটবে। আমেরিকা ও ইসরাইল এভাবেই ফিলিস্থিনে (ইউরোপের ফটক) ইসলামপন্থীদের ঘাঁটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বিপদ সম্পর্কে প্রতিবেশী ইউরোপীয়দের ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলতে চাচ্ছে যাতে সহজে ফিলিস্তিনীগণ অভ্যুত্থানকে দমনে আত্মনিয়োগ করতে পারে।] হচ্ছে এই যে, ফিলিস্তিনী সংগ্রামের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মত বিক্ষোভ মিছিলের জন্য মসজিদ ও নামাযে জুমাকে কাজে লাগানো হয়। এর আগ পর্যন্ত ফিলিস্তিনী সংগ্রাম সব সময়ই গেরিলা যুদ্ধ, অস্ত্র ও সংগঠননির্ভর ছিল। কিন্তু এবার খালি মুষ্ঠি, পাথর টুকরো ও লাঠি এসে গুলীর মুখোমুখি দাঁড়ায়। ফিলিস্তিনী নারী ও শিশুরা পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য ভাবে এ আন্দোলনে অংশ নিচ্ছে। এবার সংগ্রামের নামকরণ করা হচ্ছে ইটপাটকেলের বিপ্লব কিংবা পাথর হতে তরুন ও কিশোরদের বিপ্লব। ইন্তিফাদা আন্দোলনের আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো শাহাদতকামিতা ও আত্মবলিদান যে অস্ত্রের কোন বিকল্পই নেই। এতোসব নিষ্ঠুরতাকে মেনে নিতে তৈরী নয় বলেই এ ধরনের প্রচারণা চালিয়ে ইন্তিফাদাকে দমনের জন্য ইসরাইলীদের হাতে সুযোগ তুলে দিচ্ছে যাতে পশ্চিমারা বলতে পারে যে, যদি ফিলিস্তিনীদের দমন না করি তাহলে সেখানে ইসলামী মৌলবাদ বিকাশের ঘাঁটি তৈরী হবে এবং আন্দালুসিয়ার (স্পেনে) বিপর্যয়েরই (মুসলমানদের বিজয়) পুনরাবৃত্তি ঘটবে।
আরেকটি লক্ষণীয় দিক হচ্ছে ইন্তিফাদা হচ্ছে জাতীয়তাবাদসহ যাবতীয় সংগ্রামের ব্যর্থতায় গণপ্রতিক্রিয়া। জামাল আব্দুন নাসেরের সময় ওই জাতীয়তাবাদিতা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে ছিল। গত কয়েক বছরে আরব জাতীয়তাবাদ ও গোত্রবাদ চরমভাবে পরাজিত হয় এবং অবশেষে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর কম্যুনিষ্ট মার্কা বামপন্থী আন্দোলন ও মতগুলোবাদও চূড়ান্ত পরাজয় বরণ করে।
আমেরিকা ও ইসরাইল এভাবেই ফিলিস্থিনে (ইউরোপের ফটক) ইসলামপন্থীদের ঘাঁটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বিপদ সম্পর্কে প্রতিবেশী ইউরোপীয়দের ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলেছে যাতে সহজে ফিলিস্তিনী গণঅভ্যুত্থানকে দমনে আত্মনিয়োগ করতে পারে।
ফিলিস্তিন আন্দোলন এসব নানামুখী ও বিভিন্নধর্মী মত ও পথে অচলাবস্থা ও পরাজয় প্রত্যক্ষ করে অবশেষে এ সিদ্ধানে- উপনীত হয় যে, ইসলামই একমাত্র সমাধান, যে সমাধান অন্য কোন রাজনৈতিক দর্শনে খুঁজে পেতে পারেনি, বরং পরাজয়, আত্মসমর্পণ ও আপোষকামিতার কানাগলিতে গিয়েই অপমৃত্যু বরণ করতে বাধ্য হয়েছে। আজ ফিলিস্তিন আন্দোলন ইসলামের মাঝেই তার মুক্তির খোঁজ করছে। আর এটাই হলো আত্মনিয়োগ ও আত্মচেতনায় প্রত্যাবর্তন যা শুধু ফিলিস্থিনেই নয়, বরং সকল ইসলামী দেশ ও আরব জাহানে উত্তাল তরঙ্গমালার সৃষ্টি করে চলেছে। অতীতে ইসলামের কেবল বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক তৎপরতাই প্রমাণ ছিল। কিন্তু একজন আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় নেতা হিসাবে ইমাম খোমেনীর নেতৃত্বে ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লব বিজয় লাভের পর ইসলামী তৎপরতাসমূহ রাজনৈতিক ও কার্যকরী দিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়ে ওঠে। ফিলিস্তিনী আন্দোলন এতকাল যেখানে জাতীয়তাবাদী ধ্যান্তধারণা নিয়ে রাজনৈতিক ও সামরিক বৈশিষ্ট্যর অধিকারী ছিল সেখানে আজ ইসলামী চরিত্র বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এক আকিদায় পরিণত হয়েছে। ফিলিস্তিন জেহাদে ইসলামীর মহাসম্পাদক ডঃ ফাতহী শাকাকীর ভাষায় ইসলামী বিপ্লবের বিজয় সমগ্র বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের মাঝে জীবনাদর্শ স্বরূপ দীনের প্রতি অটল বিশ্বাস এনে দেয় এবং প্রমাণ করে যে, ইসলাম এক অপরাজেয় শক্তি এবং ইসলাম ফিলিস্তিনী জনগণের মাঝে আন্দোলন ও অভুত্থানের শক্তি [ডঃ ফাতহী শাকাকী ১৯৫১ সালে গাজা শহরে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৭৯ সালে ইমাম খোমেনী ও নয়া ইসলামী পরিকল্পনা নামক পুস্তক প্রনয়ণ করেন এবং ১৯৮৮ সালে অধিকৃত ফিলিস্তিন থেকে বহিস্কৃত হন।] ফিলিস্থিনে ইন্তিফাদা গণঅভ্যুত্থানে শুরুর ফলে যারা এখনো পর্যন্ত আরব জাতীয়তাবাদী মন্ত্রে বিশ্বাসী তারা পর্যন্ত ইসলামকে ফিলিস্তিন মুক্তির জন্যে মুক্তির এক উৎস ও আরবদের মাঝে ঐক্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যম হিসাবে মেনে নিয়েছে এমন কি অনেককে আন্তরিক ভাবেই নিজেদের চিন্তাদর্শন পুনবিবেচনা করছেন। [প্রখ্যাত ফিলিস্তিনী ব্যক্তিত্ব আহমাদ জিব্রাইল ১৯৯২ সালে তেহরানে এক সম্মেলনে বলেনঃ আমরা কেনো বলছি যে, সকল মুসলমানের কাছে আমাদের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে? এজন্যেই যে, আমরা জানি, ফিলিস্তিনীরা একাকী ফিলিস্তিনকে মুক্ত করতে সক্ষম নয় এবং এটাও জানি যে, আরব বিশ্ব ও আরব জাতীয়তাবাদ একাকী ফিলিস্তিনকে মুক্ত করতে সক্ষম নয়। তিনি আরো বলেন, অতীতে আমার চিন্তাদর্শনের মূল বৈশিষ্ট্যই ছিল দেশ, সমপ্রদায় ও জাতীয়তা। কিন্তু ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের পর বিপ্লবী ইসলামের দিকে আমার মনোযোগ আকৃষ্ট হয়। যখন শুনতে পেলাম যে, ইসলামী বিপ্লবের বয়োবৃদ্ধ নেতা ইমাম খোমেনী আমেরিকা ও পাশ্চাত্যের নাম দিচ্ছেন শয়তানে বুযুর্গ তখন তা আমার মাঝে খুবই প্রভাব ফেলে।]
ফিলিস্থিনে ইয়াহুদীদের অভিবাসন দেয়ার লক্ষ্য কেবল জমি দখলই নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্যে সাম্রাজ্যবাদের রাজনেতিক ও অর্থনৈতিক লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ছাড়াও ফিলিস্তিন ইস্যুর ভেতর লুকিয়ে থাকা ইসলামী উম্মার বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যের নয়া ক্রুসেড যুদ্ধের অশুভ উদ্দেশ্য এবং ১০৯৫ থেকে ১২৪৯ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত ক্রুসেড যুদ্ধে খৃস্টান জগৎ ও পাশ্চাত্যের পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণের স্পৃহা। তাছাড়া ১৪৫৩ খৃস্টাব্দে উসমানী সাম্রাজ্যের হাতে কনস্ট্যান্টিনোপলের (ইস্থাম্বুল) পতনে পাশ্চাত্য ও খৃস্ট জগৎ যে, অবমাননার শিকার হয় তার গ্লানি থেকেও বের হয়ে আসা। [আহমদ জিব্রাইল বলেনঃ ভাই ও বোনেরা! আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি যে, বিভিন্ন পোশাক ও আকারে ক্রুসেড যুদ্ধের অবতারণা করা ছাড়া ইস্যু অন্য কিছু নয়। পশ্চিমাও ইউরোপীয় সরকারগুলো ইসলামের কাছে অতীত পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণ করতে চাচ্ছে। (ফিলিস্তিন বিষয়ক প্রথম ইসলামী সম্মেলনের রচনাবলী, যামিল সাঈদী, ৪৭ পৃষ্ঠা।)
একইভাবে মুনীর শফিক বলেনঃ ফিলিস্তিন ইস্যু আসলে ইসলামের ইস্যু আর এ বিষয়টির সাথে দেশপ্রেম ও আরব জাতীয়তার কোন বিরোধ নেই। যেহেতু ফিলিস্তিন ইস্যুর মূল ভিত্তি ও সারবত্তা হচ্ছে ইসলামী, সেহেতু এ ভিত্তি অনুসারেই এ সমস্যার (ফিলিস্তিন) চিকিৎসা করা উচিত এবং এর ভিত্তিতেই সমাধান পেতে হবে। ফিলিস্তিন ইস্যু ইসলামী উম্মত ও তার দুশমনদের মাঝে লড়াইয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। একই ভাবেই আমাদের দুশমন তথা যায়নবাদী গোষ্ঠী ও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের যাবতীয় পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রীয় বিষয়ও হয়ে দাঁড়িয়েছে অধিকৃত ফিলিস্তিন ইস্যু। আর তাই সকল ইসলামী দেশের ইসলামী স্ট্র্যাটেজী প্রণয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে ফিলিস্তিন ইস্যুকে স্থান না দেয়া পর্যন্ত জাতীয় গণঅভ্যুত্থান, স্বাধনতা, একতা ও লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু কলেমার পতাকা উত্তোলন অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। (ফিলিস্তিন বিষয়ক প্রথম ইসলামী সম্মেলনের রচনাবলী, ১০৯ পৃঃ)]
ফিলিস্তিন আন্দোলনের বিভিন্ন মুখী সংগ্রামের অচলাবস্থা ও ব্যর্থতার পরই এ নয়া চিন্তা-দর্শনের জন্ম হয়। আরো সঠিক অর্থে বলা যায় এ চিন্তা-দর্শন তখনি শক্তি লাভ করে। এভাবে বলা যেতে পারে, ইন্তিফাদা ইসলামী বিপ্লবের সাথে ইসলামী ঝোঁক-প্রবণতার দিক দিয়ে বহু নৈকট্য ও সাদৃশ্যের অধিকারী এবং ইমাম খোমেনী ফিলিস্তিনী জনগণের কাছে চিহ্নিত আদর্শ হিসাবে গণ্য ও সম্মানের পাত্র। উনার দৃষ্টিভঙ্গি ও পথনির্দেশ ফিলিস্তিনী জনতার মনোযোগের বিষয়। আর একারণেই ইমাম খোমেনীর সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তা-দর্শনের প্রতি ফিলিস্তিনের ইন্তিফাদা আন্দোলন যথাযথ মর্যাদা দান করছে। কেননা ফিলিস্তিনী মুসলমানগণ ইমামকে ইসলামী আন্দোলনের পুনরুজ্জীবনকারী বলে গ্রহন করে নিয়েছেন।
গাজায় গণহত্যা ও মুসলিম শাসকদের গাদ্দারি
Written by ফিরোজ মাহবুব কামাল
গত ২৭শে ডিসেম্বরে ইসরাইলী যুদ্ধ বিমান এফ-১৬ গাজায় হামলা শুরু করে। মাত্র দুই দিনেই তারা তিন শতের বেশী ফিলিস্তিনীদের হত্যা করে। আহত হয়েছে দেড় হাজারেরও বেশী। আজ তৃতীয় দিনেও সে হামলা অব্যাহত ভাবে চলেছে। এফ-১৬ যুদ্ধ বিমান ব্যবহার করা হয় রণক্ষেত্রে শত্রুর যুদ্ধ-বিমান, সেনানিবাস ও বিমান-ঘাঁটি ধ্বংসে। গাজায় কোন সেনানিবাস নেই, বিমান-ঘাঁটিও নেই। সেখানে বাস করে ১৫ লাখ বেসামরিক ফিলিস্তিনী। আছে কিছু থানা ও পুলিশ ফাঁড়ি। ইসরাইল শুধু পুলিশ-ফাঁড়ি ও থানা ধ্বংসের জন্য্ই জঙ্গি বিমান ব্যবহার করেনি, তাদের এফ-১৬ বোমারু বিমানগুলো টনের পর টন বোমা ফেলেছে গাজার হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয়, তেলের ডিপো ও বসত-বাড়ীর উপর। গাজায় ক্ষুদ্র আকারের যেসব হাসপাতাল ছিল সেগুলি এতটাই বিদ্ধস্ত হয়েছে যে এখন সেগুলোর আহতদের চিকিৎসার দেবার সামর্থও নেই। রোগীরা হাসপাতালে গিয়েও নিরাপদ হতে পারছে না।
ইসরাইলের অভিযোগ, গাজা থেকে ইসরাইলের উদ্দেশ্যে রকেট ছোড়া হয়, হামলা লক্ষ্য সে রকেট ছোড়া বন্ধ করা। কিন্তু গত ৫ বছরে এসব রকেটে যত ইসরাইলী নিহত করেছে গত শনিবারে ৫ মিনিটের হামলায় তার চেয়ে বহু গুণ বেশী ফিলিস্তিনীকে হত্যা করেছে ইসরাইল। গাজাকে শুধু একটি উন্মুক্ত জেলখানা বললে ভূল হবে। জেলখানায় খাদ্যপানীয় ও চিকিৎসা বন্ধ করা হয়না, বন্ধ করা হয় না জ্বালানী বা বিদ্যুতের আলো। কিন্তু গাজায় সেগুলো বাইরে থেকে পৌঁছার রাস্তা এখন বন্ধ। এ হামলার মধ্য দিয়ে পাশ্চাত্য মূল্যবোধ ও পাশ্চাত্য রাজনীতির নীতিহীনতা পুণরায় প্রকাশ পেল। ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনীদের দেশ ত্যাগে বাধ্য করে যখন ইসরাইলের প্রতিষ্ঠা করা হল তখন সে অবৈধ আগ্রাসী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাকে জাতিসংঘ স্বীকৃতি দিল। স্বীকৃতি দিল সকল পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ। নৈতিকতার পরীক্ষায় সেদিনই শূণ্য নম্বর পেয়েছিল। ফলে এমন শূণ্য নৈতিকতা নিয়ে কোন দেশ কি গণহত্যাকে নিন্দা করতে পারে? পারে না। তাই পারেনি বর্তমান মার্কিন প্রশাসন ও তার প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ। পারেনি নতুন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও। জর্জ বুশের হোয়াইট হাউজ মুখপাত্র বলেছেন, ইসরাইল গাজায় যা কিছু করছে সেটি তার নিজদেশের মানুষের প্রতিরক্ষার স্বার্থে। এবং সে অধিকার ইসরাইলের আছে। একই সুরে একই কথা বলেছেন বারাক ওবামা। তার কথা, ইসরাইলকে এখনই বোমা বর্ষন বন্ধ করতে বলা ঠিক হবে। লক্ষণীয়, ইসরাইল যখন লেবাননে আবাসিক এলাকার উপর হাজার হাজার টন ফেলে নিরপরাধ নারী-শিশুকে হত্যা করছিল তখন একই কথা বলেছিল জর্জ বুশ। ইসরাইল তখন প্রচন্ড আস্কারা পেয়েছিল লেবাননের মাটিতে, ইতিহাসের অন্যতম বর্বরতায়। কথা হল, যারা নিজেরাই ইরাক, আফগানিস্তান এবং এর আগে ভিয়েতনামে ব্যাপক গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞকে নিজেদের জন্য স্পোর্টস বা আনন্দ-উৎসব রূপে গণ্য করে তারা ইসরাইলের গণহত্যাকে নিন্দা করার সামর্থ পাবে কোত্থেকে? তাদের ইতিহাসে তো বাগরাম, আবু গারিব ও গোয়ান্তানামো বে’র কাহিনীই বার বার রচিত হবে। ইসরাইল তো ফিলিস্তিনে সেটিই করছে।
তবে গাজার মুসলমানদের সাথে ইসরাইল যে আচরণটি করছে সেটি আদৌ অবাক হওয়ার বিষয় নয়। কারণ, মানবেতর শত্রু থেকে হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন ছাড়া আর কিইবা আশা করা যায়? এটিই তো মুসলমানদের প্রকৃত পাওনা। তারা মুসলিম ভূমি দখল করবে, সেখানে বসতি গড়বে, প্রকৃত অধিবাসীদের নির্বাসনে পাঠাবে -সেটিই তো শত্রুর স্বাভাবিক আচরণ। ইসরাইল তো সেটিই করছে। কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় হল মুসলমানদের আচরণ দেখে। বেশী বিস্ময়ের বিষয় মুসলিম রাষ্ট্রগুলির সরকার প্রধানদের আচরণ। তাদের অনেকে এখন ইসরাইলের সুরে কথা বলছে। ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস এ গণহত্যার দায়-দায়িত্ব তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্ধী দল হামাসের উপর চাপিয়েছে। একই সুর মিশর সরকারের। গত হিযবুল্লাহ-ইসরাইল যুদ্ধে ইসরাইল যখন লেবাননের আবাসিক এলাকার উপর শত শত টন বোমা ফেলছিল, লেবাননের সেকুলার রাজনৈতিক নেতারা তখন সে হামলা শুরুর জন্য ইসরাইলকে ততটা দায়ী করেনি, যতটা দায়ী করেছিল ইসরাইলের সাথে যুদ্ধরত হিযবুল্লাহকে। হিযবুল্লাহর প্রতিরোধকে সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী তো হটকারিতা বলে আখ্যায়ীত করেছিল। মিশর, জর্দান, তুরস্কের যতটা ঘনিষ্টতা ইসরাইলের সাথে সে সম্পর্ক হামাস বা ফিলিস্তিনীদের সাথে নাই। স্মরণীয় যে, ২৭শে ডিসেম্বরে হামলা শুরুর ক’দিন আগে ইসরাইলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কায়রোতে মিশরের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে দেখা করে। নিশ্চয়ই সে সাক্ষাতে ইসরাইলী পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিশরকে অবহিত করেছিল যে তারা হামলা করতে যাচ্ছে। গাজা একটি জেলখানা। আর এ জেলখানার কয়েকটি দরজা ইসরাইলের দিকে। আর একটি দরজার মুখ মিশরের দিকে। মিশরের অর্পিত দায়িত্ব হল, সে দরজাটি কঠোর ভাবে বন্ধ রাখা। আর মিশর সেটিই করছে। গাজার অভ্যন্তরে খাদ্য-পানীয়-ঔষধ প্রবেশের উপর যে নিষেধাজ্ঞা ইসরাইলী কর্তৃপক্ষ আরোপ করেছে সেটি ইসরাইল যেমন পালন করছে তেমনি পালন করছে মিশরও।
মুসলিম দেশের রাস্তায় প্রতিবাদে নামলে সেখানে শত্রুর মিজাইল এসে পড়ে না যেমনটি গাজায় হয়। এমন প্রতিবাদে ত্ই রক্তব্যয় হয় না, জেলজুলুমের মুখেও পড়তে হয় না। কিন্তু সে প্রতিবাদও কি মুসলিম দেশে হচ্ছে? অথচ এমন প্রতিবাদ তো ইসলামে ইবাদত। এমন প্রতিবাদের জ্বিহাদের মর্যাদা। নবীজী (সাঃ) বলেছেন, তোমরা অন্যায়কে পাড়লে শক্তি দিয়ে রূখ। সেটি সম্ভব না হলে মুখ দিয়ে প্রতিবাদ কর। আর সেটিও সম্ভব না হলে অন্ততঃ অন্তর দিয়ে ঘৃণা কর। মুসলমানদের শক্তি দিয়ে রুখবার সামর্থ যে নাই সেটি আর ব্যাখা করে বুঝানো লাগবে না। কিন্তু মুখ দিয়ে প্রতিবাদের সাহসও কি আছে? থাকলে তার প্রমাণ কই? শত শত অমুসলমান ব্রিটিশ নাগরিক ইসরাইলী হামলার প্রতিবাদে লন্ডনে রাস্তায় গর্জে উঠেছে হামলার পরের দিনই অর্থাৎ গত ২৮ তারিখ রবিবার। অথচ মুসলিম রাষ্ট্রের শাসকেরা আগামী বুধবারের আগে একটু বসার সময়ও করতে পারলো না। কয়েকটি শহর ছাড়া, প্রতিবাদে অধিকাংশ মুসলিম দেশের জনগণও নামেনি রাস্তায়। এরূপ অন্যায় আগ্রাসন ও হত্যার বিরুদ্ধে লন্ডনে যে আকারের মিছিল হয়, মুসলিম দেশের কোন নগরীতে সেটি হয় না। ইরাকে মার্কিন হামলার বিরুদ্ধে লন্ডনে ২০০২ সালে যে ২০ লাখ মানুষের মিছিল হয়েছিল সেটি কোন মুসলিম দেশের নগরীতে হয়নি। অথচ করাচী, ঢাকা, কায়রো ও জাকার্তার মত নগরীতে কোটি লোকের বসবাস। প্রশ্ন হল, তাদের ব্যস্ততা বা সময়ের মূল্য কি লন্ডনের শহরবাসীদের চেয়ে বেশী? লন্ডনের ব্যস্ত মানুষ যদি বিপুল সংখ্যায় রাস্তায় নামতে পারে তবে সেটি কেন মুসলিম দেশের নাগরিকগণ পারে না? ৫৫টি মুসলিম দেশের রাজধানী ও বড় বড় নগরীতে লক্ষ লক্ষ মানুষের মিছিল হলে, বিশ্ব-রাজনীতিতে কি তার প্রভাবটি বিশাল হত না? অথচ সেটি হয়নি। গবাদী পশু সামনে ঘাস পেলে সে পাশের গরুকে জবাই করলেও তাকিয়ে দেখে না। বরং নীরবে ঘাস খায়। তেমনি অবস্থা মুসলমানদেরও। ফলে কাশ্মির, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিনে লক্ষ লক্ষ মুসলমানের মৃত্যূ হলে কি হবে, তা নেই তেমন মাতম নেই। তীব্র প্রতিবাদও নাই। মুসলমানদের এ অবস্থার কারণ এ নয় যে মুসলমানেরা ঘাস খায়। ভাত মাছ খেয়েও মানুষ যে পশুর চেয়ে নিকৃষ্টতর হতে পারে সে সাক্ষী দিয়েছেন তো স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা। তিনি বলেছেন, “উলায়েকা কা আল আনয়াম, বাল হুম আদাল” অর্থ হল, তারাই হল পশু বরং; তার চেযেও নিকৃষ্টতর। আর সে নিকৃষ্টতর পর্যায়ে পৌঁছার কারণ ঈমানশূণ্যতা। এ ঈমানশূণ্যতার কারণে ৯০% মুসলমানের দেশে অসম্ভব হয়েছে আল্লাহর দ্বীনের বিজয়, এবং সম্ভব হয়েছে দূর্নীতিতে বিশ্ব-শিরোপালাভ। দুস্থ্য মানুষের আত্মচিৎকারে ছুটে যাওয়ার সামর্থ সবার থাকে না। এজন্য দেহের বল নয়, চাই নৈতিকতার বল। চাই ঈমানের বল। সে ঈমানের বলের কারণে সূদুর ইরাক থেকে মুহম্মদ বিন কাসিমের বাহিনী সিন্ধু দেশে ছুটে এসেছিল। এবং সেটিও কোন মুসলমান বাঁচাতে নয়, রাজা দাহিরের নির্যাতন থেকে হিন্দু মহিলাদের বাঁচাতে। ১১ই সেপ্টম্বর নিউয়র্কে মাত্র তিনহাজার মার্কিনী নিহত হয়েছিল, আর এর প্রতিশোধ নিতে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান ও ইরাক দখল করে নি্ল। মুম্বাইয়ে বন্দুকধারিদের হামলার বদলা নিতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একটা প্রকান্ড যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে ভারত। অথচ দুই লাখ মুসলমান নীরবে মারা গেল বসনিয়ায়, এখনও লাখ লাথ মারা যাচ্ছে আফগানিস্তান, ইরাক ও কাশ্মিরে। মুসলিম বিশ্বের কোথাও তেমন প্রতিবাদ নাই। অথচ পবিত্র কোরআনে এক মুসলমানকে অপর মুসলমানের ভাই বলা হয়েছে। অন্তরে ঈমান থাকলে অপর ভাইয়ের বেদনার অনুভুতিও থাকে। আগুন থাকলে যেমন উত্তাপও থাকে। তাই ঈমানশূণ্যতার বড় প্রমাণ, মুসলমানের মধ্যে সে ভাতৃত্ব-বোধ না থাকা। এক মুসলমান ভাইয়ের পায়ে কাটা বিদ্ধ হলে অন্য মুসলমানের মনে তখন ব্যথা অনুভুত হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু আজ পায়ে কাটা বিদ্ধ হওয়ার বিষয় নয়, বিষয় লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর। কিন্তু কোথায় সে ভাতৃ-সুলভ প্রতিক্রিয়া। কোথায় সে প্রাণের টান। কোথায় সে আর্থিক ও মানবিক সাহায্য?
মুসলমানদের বিশ্বাসঘাতকতা বা গাদ্দারী নিছক ফিলিস্তিন, কাশ্মির, আফগানিস্তান বা বসনিয়ার মুসলমানদের সাথে নয়, বরং মূল গাদ্দারীটি হল মহান আল্লাহতায়ালার সাথে। মুসলমান হওয়ার অর্থই হল, মহান আল্লাহর অনুগত বান্দাহ হয়ে যাওয়া। সে আনুগত্যের দাবী হল, একমাত্র আল্লাহর রশিকে সে আঁকড়ে ধরবে এবং একতাবদ্ধ হবে। এবং মহান আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠায় আত্ম-নিয়োগ করবে। এ কাজে শ্রম দিবে, অর্থ দিবে এবং প্রয়োজনে প্রাণও দিবে। বিণিময়ে পরকালে পাবে জান্নাত। নবীজী (সাঃ) ও সাহাবায়ে কেরাম সেটিই করেছেন। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, “ওয়া তাছিমু বি হাবলিল্লাহি জামিয়াঁও ওয়া লাতাফাররাকু” অর্থ: আল্লাহর রশিকে আঁকড়ে ধর এবং পরস্পরে বিচ্ছিন্ন হয়োনা। কিন্তু আফসোস হল, মুসলমানেরা আল্লাহর সে নির্দেশের প্রতি আনুগত্য দেখাতে পারেনি। এক্ষেত্রে তাদের গাদ্দারীটি প্রকান্ড। কোরআনকে নয়, তারা আঁকড়ে ধরেছে কাফেরদের দেওয়া কুফরি জীবন দর্শনকে। এজন্যই মুসলিম দেশে ঘুষ, জুয়া, পতিতাবৃত্তির এত প্রসার। এবং আল্লাহর দ্বীন পরাজিত প্রতিক্ষেত্রে। শরিয়তের পরিবর্তে আদালতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে কুফরি আইন। আল্লাহতায়ালা সূদকে হারাম ঘোষণা দিয়েছেন। অথচ গাদ্দারী হয়েছে আল্লাহর সে ঘোষনার সাথেও। তারা পাত্তাই দেয়নি মহান আল্লাহর সে মহান ঘোষণাকে। পাত্তা দেয়নি উনার একতাবদ্ধ হওয়ার নির্দেশকে। এর বিপরীতে তারা গুরুত্ব দিয়েছে, ভাষা, দেশ, পরিবার ও বর্ণ-ভিত্তিক একতাবদ্ধ হওয়াকে। এমন স্বার্থপরতায় গুরুত্ব হারিয়েছে মুসলিম বা ইসলামের স্বার্থ। মুসলমান ও ইসলাম আজ সত্যিকার অর্থেই তাই প্রতিরক্ষাহীন। এজন্যই লক্ষ লক্ষ মুসলমান আজ নিহত হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। অধিকৃত হচ্ছে দেশের পর দেশ। অথচ কোন মুসলিম দেশেই এবিষয়টি রাজনীতি বা পররাষ্ট্র নীতির বিষয় নয়।
মুসলিম বিশ্বে ইসরাইলী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নীরবতার কারণ অনেক। প্রথম কারণটি হল, মুসলমানদের চেতনাগত দুরাবস্থা। তবে বড় কারণ, মুসলিম দেশগুলোর সরকারগুলো। এ সরকারগুলোর কারণে প্রতিটি মুসলিম দেশ যেন একেকটি জেলখানা। কোন কোন দেশের জনগণের অবস্থা গাজার বন্দী মানুষদের চেয়েও নিকৃষ্ট। তবে পার্থক্য হল, গাজার মানুষের মিছিলের অধিকার আছে এবং অধিকারও আছে সে মিছিলে প্রতিবাদের আওয়াজ তোলার। অধিকার আছে শত্রুর বিরুদ্ধে জ্বিহাদের। কিন্তু সে অধিকার মিশর, সৌদি আরব, জর্দান, তিউনিসা, লিবিয়া, কুয়েত, বাহরাইনের মত অধিকাংশ মুসলিম দেশে নেই। যেমন জেলখানার মানুষের খাদ্যপানীয় গ্রহণের স্বাধীনতা থাকলেও স্বাধীনতা থাকে না রাস্তায় নেমে প্রতিবাদের। এমন প্রতিবাদ জেল-কোড বিরোধী। এসব দেশের সরকারগুলো জেলার বা কারাপ্রশাসক ভিন্ন বেশী কিছু নয়। এদের উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে অর্পিত দায়িত্ব হল কারাবন্দীদের উপর তথা দেশের নাগরিকদের উপর কড়া নজরদারি রাথা। প্রয়োজনে বিদ্রোহীদের হত্যা করাও। এজন্যই ফিলিস্তিন, লেবানন বা ইরাকে শত্রুশক্তি যখন আগ্রাসী যুদ্ধ শুরু করে তখন সে যুদ্ধের বিরুদ্ধে এসব দেশে কোন প্রতিবাদী মিছিল হয় না। যদি কেউ প্রতিবাদ মিছিলে নামে তবে তাদের গ্রেফতার করা হয় এমন কি হত্যাও করা হয়। আর এমন কাজের মধ্য দিয়ে বাহবা পায় এসব দেশের কারারক্ষিতুল্য সরকার। ফলে শক্তি না থাকলে মুখের ভাষায় প্রতিবাদের যে নসিহত করেছেন নবীজী (সাঃ) সেটিও পালনের সুযোগ নেই এসব স্বৈরাচার কবলিত মুসলিম দেশে।
আরব রাষ্ট্রপ্রধানগণ সিন্ধান্ত নিয়েছে, আগামী বুধবার ৩১শে ডিসেম্বর দোহাতে তারা মিলিত হবে। কথা হলো, মৌখিক মৃদু প্রতিবাদ ছাড়া তাদের তো আর কিছু্ই করার সামর্থ নেই। কিন্তু সেটিতেও কেন এত দেরী? তবে কি প্রতিবাদের সামর্থ দূরে থাক, ঘৃণার সামর্থই লোপ পেয়েছে? ঘৃণার সামর্থ যে লোপ পেয়েছে সেটি প্রকাশ পায় এভাবে, তারা এখন ইসরাইলকে বাদ দিয়ে কঠোর নিন্দা করছে হামাসকে। অথচ হামাসই হচ্ছে সমগ্র আরব বিশ্বে একমাত্র বৈধ সরকার। একমাত্র তারাই পেয়েছে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইনগত বৈধতা যা আর কোন আরব দেশগুলির সরকারের নাই। বৈধতা নাই যেমন মিশরের স্বৈরাচারি শাসক হোসনী মোবারকের যেমন তেমনি নেই সৌদিআরব, সিরিয়া, ইরাক, জর্দান, লিবিয়াসহ অন্যান্য আরব দেশেগুলোর সরকারের। খাঁচার পাখিরা কখনো কি বাইরের মুক্ত বিহঙ্গকে পছন্দ করে? কাছে পেলে তো তার মাথায় ঠোকর মারা শুরু করবে। তেমনি সম্পর্ক হামাসের সাথে এসব দেশের সরকারদের। ফলে তাদের রাগ গিয়ে পড়েছে হামাসের উপর। মিশর ও জর্দানের মত দেশগুলো অবৈধ ও আগ্রাসী ইসরাইলকে স্বীকৃত দিয়েছে, কিন্তু তারা স্বীকৃতি দেয়নি নির্বাচিত হামাস সরকারকে। স্বীকৃতি দেয়নি অন্যান্য আরব দেশগুলোও। কারণ, হামাসের মধ্যে তারা প্রতিরোধের তথা জ্বিহাদের গন্ধ পায়। হামাসকে ঘৃণা করার মূল কারণ মূলতঃ এখানেই। কারণ তারা তো এমন এক ইসলাম চায় যেখানে জ্বিহাদ থাকবে না। থাকবে না আল্লাহর আইন বা শরিয়ত প্রতিষ্ঠার কোন দাবী। মুসলিম ভূমি অধিকৃত হলে বা সেখানে লাখো মানুষের মৃত্যু হলেও সে ইসলামে তার বিরুদ্ধে জ্বিহাদ বা প্রতিরোধ থাকবে না। মার্কিনীরাও তো এমন ইসলামই চায়। এসব মুসলিম শাসকদের লক্ষ্য, আল্লাহকে খুশি করা নয়, বরং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলকে খুশি করা। সেটি নিজদেশের মুসলমানদের হত্যা করে হলেও। পাকিস্তান সেনাবাহিনী একই কারণে ইসলামাবাদের লাল মাদ্রাসা ধুলিস্যাৎ করেছে এবং হত্যা করেছে সে মাদ্রাসার বহু শত নিরীহ ছাত্রীদের। হত্যা করে চলেছে দেশটির জ্বিহাদী মোজাহিদদের। একই ভাবে আলজেরিয়ার সেনাবাহিনী সে দেশের নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী ইসলামী সালভেশন পার্টির নেতা-কর্মীদের হত্যা করাকে নিজেদের পেশাদারি দায়িত্ব মনে করে। তুরস্কের সেনাবাহিনী তো সে দেশের মহিলাদের মাথায় রুমাল বেধে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে বা সরকারি অফিস আদালতে যেতে দিতেই রাজী নয়। একই রূপ ইসলাম-বিরোধী ভূমিকায় নেমেছে মুসলিম দেশগুলোর সেকুলার রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীগণ। তাদের আনন্দ ও বিজয়-উৎসব তো আল্লাহর বিধানের পরাজয় দেখার মধ্যে। আর এটি কি আল্লাহ ও তার দ্বীনের বিরুদ্ধে কম গাদ্দারী?
সূত্রঃ
১) ‘জাগারণ’ নামক ব্লগার
[বিঃদ্রঃ তথ্য প্রদানে ও ভাষাগত কোন ভুল থাকলে দয়া করে মেইল করে জানাবেন]
[ট্যাগঃ পীর-মুরীদি (মুরিদি) ব্যবসাধারী ভন্ড-পীর সহ ধর্মব্যবসায়ীদের জম রাজারবাগ দরবার শরীফ, রাজারবাগী পীর সাহেব কিবলা আলাইহিস সালাম]