নোটিশ

শনিবার, ৪ আগস্ট, ২০১২

মুসলিম নির্যাতন (৩)- আফগানিস্তানে মুসলিম গণহত্যা ও নির্যাতনের নির্মম ইতিহাস


আফগানিস্তান পরিচিতি


আফগানিস্তান দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার একটি রাষ্ট্র। রাষ্ট্রটি ইরান, পাকিস্তান, চীন, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান, ও তুর্কমেনিস্তানের মধ্যস্থলে একটি ভূ-বেষ্টিত মালভূমির উপর অবস্থিত। আফগানিস্তানকে অনেক সময় দক্ষিণ এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের অংশ হিসেবেও গণ্য করা হয়।
আফগানিস্তানের পূর্বে ও দক্ষিণে পাকিস্তান, পশ্চিমে ইরান, উত্তরে তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান ও তাজিকিস্তান এবং উত্তর-পূর্বে গণচীন। আফগানিস্তান শব্দটির অর্থ "আফগান (তথা পশতুন) জাতির দেশ"। দেশটির আয়তন ৬৪৭,৫০০ বর্গকিমি।

আফগানিস্তানে ইসলামের আগমণঃ

খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীতে আরব সৈন্যরা আফগানিস্তানে নতুন ধর্ম ইসলাম নিয়ে আসেন। পশ্চিমের হেরাত ও সিস্তান প্রদেশ আরবদের নিয়ন্ত্রণে আসে, কিন্তু আরব সৈন্য চলে যাওয়া মাত্রই সেখানকার জনগণ তাদের পুরনো ধর্মে ফেরত যায়। ১০ম শতকে বর্তমান উজবেকিস্তানের বুখারা থেকে সামানিদ নামের মুসলিম শাসকবংশ আফগান এলাকায় প্রভাব বিস্তার করা শুরু করেন। এক সামানিদ গজনীতে গজনবী রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। গজনীর সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা মাহমুদ ৯৯৮ থেকে ১০৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এ এলাকা শাসন করেন এবং তাঁর সময়েই সমগ্র আফগানিস্তানে ইসলাম সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। গজনী সাহিত্য ও শিল্পের কেন্দ্রে পরিণত হয়।
মাহমুদের মৃত্যুর পর গজনীর প্রভাব হ্রাস পেতে থাকে এবং ১২শ শতকে পশ্চিম-মধ্য আফগানিস্তানের ঘুর শহরে ঘুরিদ রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ঘুরিদরা আবার ১৩শ শতকে মধ্য এশিয়ার খোয়ারিজমি শাহদের কাছে পরাজিত হন। ১২২০ সালে মঙ্গোল সেনাপতি চেঙ্গিস খান এদের সবাইকে পরাজিত করে দেশটির অশেষ ক্ষতিসাধন করেন।
১৪শ শতাব্দীর শেষে মধ্য এশীয় সেনাপতি তৈমুর লং আফগানিস্তান জয় করেন ও ভারতে অগ্রসর হন। তাঁর সন্তান ও পৌত্রেরা তাঁর সাম্রাজ্যের পুরোটা ধরে রাখতে পারেনি, তবে তারা বর্তমান আফগানিস্তানের অধিকাংশ হেরাত থেকে শাসন করতে সক্ষম হয়।
ঘুরিদ থেকে তিমুরীয় সাম্রাজ্যের শাসনামলে এখানে ইসলামী স্থাপত্যের বিকাশ ঘটে। এসময় তৈরি বহু মসজিদ ও মিনার আজও হেরাত, গজনী ও মাজার-ই-শরিফে দাঁড়িয়ে আছে। হেরাতে ১৫শ শতকে ক্ষুদ্রাকৃতি চিত্রকর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারার বিকাশ ঘটে।
জহিরুদ্দীন মুহম্মদ বাবর ছিলেন মায়ের দিক থেকে চেঙ্গিস খানের বংশধর আর বাবার দিক থেকে তৈমুর লঙের বংশধর। তিনি ১৫০৪ সালে কাবুল দখল করেন এবং তারপর ভারতে গিয়ে মুঘল সাম্রাজ্য স্থাপন করেন।
১৬শ ও ১৭শ শতাব্দীর পুরোটা জুড়ে ভারতে অবস্থিত মুঘল সাম্রাজ্য এবং পারস্যের সাফাউইদ রাজবংশের রাজারা আফগানিস্তানের দখল নিয়ে যুদ্ধ করেন। সাধারণত মুঘলেরা কাবুলের দখল রাখত এবং পারসিকেরা হেরাত দখলে রাখত, আর কান্দাহারের শাসনভার প্রায়ই হাতবদল হত। এসময় পশতুন জাতি তাদের শক্তিবৃদ্ধি করে, তবে স্বাধীনতা লাভে ব্যর্থ হয়।

বিংশ শতাব্দীর আফগানিস্তানঃ

১৭৪৭ সালে আহমদ শাহ দুররানি কান্দাহার শহরকে রাজধানী করে এখানে দুররানি সাম্রাজ্যের পত্তন করেন। তখন থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তান একটি রাজতন্ত্র ছিল। এরই মাঝে দেশের রাজধানী কান্দাহার থেকে কাবুলে স্থানান্তরিত করা হয় এবং দেশটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির কাছে অনেক অঞ্চল হারায়। ১৯শ শতকে দেশটি ব্রিটিশ ভারতীয় সাম্রাজ্য ও রুশ সাম্রাজ্যের মধ্যে এক বিরাট খেলার মধ্যবর্তী ক্রীড়ানক রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ১৯৭৩ সালে একটি সামরিক অভ্যুত্থানে সামরিক অফিসারেরা রাজার পতন ঘটান এবং একটি প্রজাতন্ত্র গঠন করেন। ১৯১৯ সালে তৃতীয় ব্রিটিশ-আফগান যুদ্ধশেষে আফগানিস্তান দেশটি ব্রিটেন থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে।
১৯৬০-এর দশক পর্যন্ত আফগানিস্তানের রাজা ও তাঁর আত্মীয়েরা কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ন্ত্রণ করতেন। তবে রক্ষণশীল গোষ্ঠীগত ও ধর্মীয় নেতারাও শাসনব্যবস্থায় প্রভাব বিস্তার করতেন। ১৯৬৩ সালে প্রথমবারের মত রাজপরিবারের বাইরের একজনকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ দেয়া হয় যাতে রাজতন্ত্র আইন প্রণয়নের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পায়। ১৯৬৪ সালের নতুন সংবিধানে দেশটিতে আরও গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়, যেখানে রাজা কেবল নির্বাচিত আইনসভার সাংবিধানিক প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তবে এসময় রাজা রাজনৈতিক দলের বৈধকরণের বিরোধিতা করেন, মূলত জাতিগত ও বামপন্থী দল যাতে গঠিত হতে না পারে, সে কারণে।
১৯৭০-এর দশকের শেষের দিকে আফগানিস্তানে এক দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৭৩ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে রাজতন্ত্রের পতন ঘটে এবং প্রজাতন্ত্র হিসেবে আফগানিস্তানের আবির্ভাব ঘটে। ১৯৭৮ সালে আরেকটি অভ্যুত্থানে নিষিদ্ধ বামপন্থী দল পিপল্‌স ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অফ আফগানিস্তান (পিডিপিএ) ক্ষমতায় আসে। এই দলের সাম্যবাদী শাসন সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে আফগানিস্তানের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করে। তবে ইসলামী বিদ্রোহী মুজাহেদিনেরা এই শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করে। গৃহযুদ্ধে হস্তক্ষেপের অভিপ্রায়ে ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান আক্রমণ করে এবং সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধ শুরু হয়।
পিডিপিএ-কে সমর্থন করার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে আফগানিস্তানে একটি পূর্ণ-মাপের আক্রমণ পরিচালনা করে। এই আক্রমণের পরে একজন মধ্যপন্থী পিডিপিএ নেতাকে প্রধানমন্ত্রী করা হয়, যাতে মুজাহেদিনেরা শান্ত হয়। কিন্তু মুজাহেদিনেরা সোভিয়ত অধিকৃতির বিরুদ্ধে গেরিলা হামলা অব্যাহত রাখে। পিডিপিএ সরকার সোভিয়েত সরকারের কাছ থেকে আর্থিক ও সামরিক সহায়তা পেত, অন্যদিকে মুজাহেদিনেরা যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, সৌদী আরব ও অন্যান্য মুসলিম দেশ থেকে সাহায্য পেত।
১৯৮৯ সালে সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহারের পর আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। মুজাহেদিনেরা পিডিপিএ সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণ জোরদার করে। অবশেষে ১৯৯২ সালে সরকারের পতন ঘটে, কিন্তু মুজাহেদিনদের ভিতরের দলীয় কোন্দলের কারণে গৃহযুদ্ধ শেষ হয়নি। একদল মুজাহেদিন তালেবান নামের একটি ইসলামী মৌলবাদী আন্দোলন শুরু করে এবং ১৯৯৬ সালে কাবুল দখল করে। তালেবান সন্ত্রাসবাদী দল আল-কায়েদাকে আফগানিস্তানে আশ্রয় দেয়। ১১ই সেপ্টেম্বর, ২০০১-এর সন্ত্রাসী হামলার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান আক্রমণ করে এবং ২০০১-এর শেষে তালেবানদের উৎখাত করে। ২০০১-এর নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সহায়তায় উত্তরাঞ্চলীয় জোট তালেবানদের পতন ঘটায়।
তালেবানদের পতনের পর জাতিসংঘ দেশটিতে বহুজাতিগোষ্ঠীয় সরকার স্থাপনে উৎসাহ দেয়। জার্মানির বন শহরে এ নিয়ে সম্মেলনের পর ২০০১-এর ডিসেম্বরে আফগানিস্তানে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। তার ৬ মাস পরে একটি মধ্যবর্তী সরকার গঠিত হয় যা ২০০৪ সালে একটি নতুন সংবিধান পাশ করে এবং একটি রাষ্ট্রপতি-ভিত্তিক গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা চালু হয়।। নতুন সংবিধান অনুযায়ী আফগানিস্তানে প্রেসিডেন্ট-ভিত্তিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ২০০৪ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আফগানিস্তানের প্রথম সরাসরি ভোটে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ক্ষমতা গ্রহণ করে।

সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধঃ

সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধ হয়েছে ইউনিয়ন অফ সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক্‌স” (USSR) এর সামরিক বাহিনী এবং আফগানিস্তানের কম্যুনিস্ট-বিরোধী গেরিলাদের মধ্যে। শুরু হয়েছে ১৯৭৯ সালে, শেষ হয়েছে ১৯৮৯ সালে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহারের মাধ্যমে। যুদ্ধের শুরুতে আফগানিস্তানের মোট জনসংখ্যা ছিল ১ কোটি ৫৫ লক্ষ। যুদ্ধে আনুমানিক ১০ লক্ষ আফগান প্রাণ হারিয়েছে যার সিংহভাগই ছিল বেসামরিক জনতা। রুশ বিমানগুলো নির্বিচারে আফগানিস্তানের গ্রামের পর গ্রাম জনশূন্য করে দিয়েছে, বৃষ্টির মত বোমাবর্ষণ করেছে সাধারণ মানুষের ওপর।
সোভিয়েত বাহিনী প্রথম আফগানিস্তানে (তদানীন্তন গণপ্রজাতন্ত্রী আফগানিস্তান) প্রবেশ করেছিল ১৯৭৯ সালের ২৭শে ডিসেম্বর। এই প্রবেশের পেছনেও অবশ্য কার্যকারণ আছে। সোভিয়েত অনুপ্রবেশের আগে আগে ক্ষমতাসীন পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি অফ আফগানিস্তান” (পিডিপিএ) দুই ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। দুই গ্রুপের মধ্যে রীতিমত সংঘর্ষ শুরু হয়েছিল। ১৯৭৮ সালে সামরিক বাহিনীর বামপন্থী কর্মকর্তাদের ক্যু-র মাধ্যমেই পিডিপিএ ক্ষমতা দখল করেছিল। পার্টির দুই ভাগের নাম খালক” (জনতা) ও পারচাম” (পতাকা)। খালক ছিল কট্টরপন্থীদের দল, অপেক্ষাকৃত মডারেটরা গঠন করেছিল পারচাম।
সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগান কম্যুনিস্টদের খালক অংশের নেতা হাফিজুল্লাহ আমিনকে হত্যা করে পারচাম অংশের নেতা বাবরাক কারমালের নেতৃত্বে একটি পুতুল সরকার গঠন করে। বাবরাক সোভিয়েত ইউনিয়নে নির্বাসন জীবন ত্যাগ করে আফগানিস্তানে ফিরে আসলেই দেশের সব অভ্যন্তরীন কোন্দল দূর হবে বলে আশা করেছিল সোভিয়েতরা। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল আফগানিস্তানকে পুরোপুরি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখা। কারণ এর মাধ্যমেই কেবল যুক্তরাষ্ট্রের হুমকি থেকে নিরাপদ থাকা সম্ভব। আফগানিস্তান যেহেতু তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী দেশ ছিল সেহেতু এ অঞ্চলে একটি ব্রিজহেড (অগ্রসর বাহিনী শত্রুপক্ষের যে এলাকা দখল করে পশ্চাৎ বাহিনীকে সামনে এগুনোর সুযোগ করে দেয়) স্থাপনের মাধ্যমে মার্কিনীরা অনায়াসেই সোভিয়েতদের সাথে সরাসরি সীমান্ত সংস্পর্শ তৈরী করতে পারতো। তাছাড়া অতি সম্প্রতি ইরানে ইসলামী বিপ্লবের কারণে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে তার একটি গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হারিয়েছিল। সবারই জানা, খোমেনীর আগে ইরানের ক্ষমতায় আসীন শাহের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সুসম্পর্ক ছিল। তো, এই নাজুক পরিস্থিতিতে যে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র মিত্র সংকটে ভুগছিল সেটা বোঝার জন্য কেজিবি হওয়া লাগে না। স্নায়ু যুদ্ধের এই ক্রিটিক্যাল মুহূর্তে তাই প্রথম চালটা চেলেছিল সোভিয়েতরাই।
সোভিয়েত আগ্রাসন যথারীতি যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কে আলোড়ন সৃষ্টি করে। বিদ্রোহী হয়ে ওঠে অনেকে। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার আফগানিস্তানের ইসলামী প্রতিরোধ বাহিনীকে সাহায্য করার জন্য একটি নতুন প্রোগ্রাম হাতে নেয় যা মুজাহিদিননামে সুপরিচিত। ১৯৭৯ থেকে ১৯৯১-এ সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র এই প্রোগ্রামের অধীনে আফগানিস্তানকে আনুমানিক ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সাহায্য দেয়- অস্ত্র-শস্ত্র সহ বিভিন্ন উপায়ে।
সোভিয়েত বাহিনী আফগানিস্তান থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছিল জেনেভা অ্যাকর্ডএ স্বাক্ষরের মাধ্যমে। জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। অ্যাকর্ডের শর্ত ছিল, ১৯৮৯ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারির মধ্যে সকল সোভিয়েত সৈন্যকে আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহার করে নিতে হবে। আসলে সোভিয়েত বাহিনী তাদের ১০০,০০০ এরও বেশি সৈন্য নিয়ে কখনই আফগান প্রতিরোধ বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। এই প্রতিরোধ বাহিনীকে সাহায্য করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, সৌদি আরব, চীন, ইরান, ইসরায়েল (বিশেষতঃ মোসাদ) এবং আরও কিছু দেশ। এছাড়া পারস্য উপসাগরের ধনকুবের ব্যবসায়ীরাও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল।
১৩,০০০ সৈন্য হারানোর পর সোভিয়েত বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়, সোভিয়েত সাম্রাজ্যের সংস্কারবাদী নেতা মিখাইল গর্বাচেভ খানিকটা লজ্জার সাথেই তার প্রচণ্ড ব্যয়বহুল ভুলটা শুধরে নেয়ার চেষ্টা শুরু করেন। এই প্রত্যাহার প্রক্রিয়ায় গর্বাচেভের সিদ্ধান্তের যে একটা বড় ভূমিকা আছে এটা বোঝা যায় এভাবে: জেনেভা অ্যাকর্ডের পরও মার্কিন সরকার অ্যাকর্ডের শর্ত লংঘন করে মুজাহিদদের অস্ত্র সাহায্য দিতে থাকে। কিন্তু এই সাহায্যে ভয় পেয়ে সোভিয়েতরা পিছু হটেনি, পিছু হটেছে নিজেদের ইচ্ছায়। অ্যাকর্ড পরবর্তী এই অস্ত্র সাহায্য উল্টো যে কাজটা করেছে তা হল, চরমপন্থী মুজাহিদ গোষ্ঠী গঠনের ভিত্তি তৈরী করে দিয়েছে। এই সাহায্যের মাধ্যমেই আফগানিস্তানে সবচেয়ে চরমপন্থী মুজাহিদ গ্রুপগুলো বিকশিত হতে শুরু করে, সেই সাথে আরব বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তাদের সাহায্য আসার পথটাও কুসুমাস্তীর্ণ হয়। উল্লেখ্য সেই সময় গঠিত এসব ইসলামী মৌলবাদী দলগুলোর মধ্যে আল-কায়েদাও ছিল। ১৯৮৮ সালে আফগানিস্তানের মুজাহিদিন ক্যাম্পেই আল-কায়েদা গঠিত হয়। তাই এ কথা অনায়াসে বলা যায়, আফগানিস্তানে আসলে আফগানদের জয় হয়নি হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের জয় এবং সোভিয়েত বাহিনীর পশ্চাদপসরণ কোন শান্তি আনেনি বরং প্রথিবী হারিয়েছে আরেকটি গনতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এই সংঘাত সমাজতান্ত্রিক জোটের প্রতি আমেরিকার চাল ছিল। আসলে এর লক্ষ্য ছিল আফগানদের মুক্তির পক্ষে নয়, বরং মার্কিনিদের নিজেদের ঘাটি শক্ত করে ধর্মান্ধ এক রাষ্ট্র বানানো।

আমেরিকার ষড়যন্ত্রঃ

সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন আফগানিস্তান আক্রমণ করেছিল, তখন আমেরিকাইন আফগানিস্তানকে অর্থ, শক্তি, অস্ত্র-শস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছিল, আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েতের প্রভাব মুক্ত করার জন্য। সে সময় তারা যুদ্ধের নানা কৌশলও আফগান মুসলমানদের শিখিয়েছিল। এ সময় তারা মুজাহেদীন বাহিনী ও আল-কায়েদা বাহিনী গঠন করেছিল। কিন্তু সোভিয়েত যখন আফগানিস্তান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে পরাজয় বরণ করল, তখন আমেরিকার শকুন চোখ পেয়ে বসল তেলের খনিসমৃদ্ধ আফগানিস্তানের দিকে। আফগানিস্তানের ভূমি দখলে নেওয়ার জন্য একটা আক্রমণের প্রয়োজন। আর সেটার জন্যই আমেরিকা একটা নাটক সাজালো যা ৯/১১ নামে পরিচিত। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকার ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারেএক বিমান হামলা চালানো হয়। অনেক বিচার বিশ্লেষণ করে, অনেকে মত দিয়েছেন যে, সে বিমান হামলা আমেরিকা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সংগঠিত হয়েছিল, যা অনেকটা আমেরিকার আত্মঘাতি সন্ত্রাসবাদ। এটাকেই বুঝি আমেরিকা আন্তর্জাতিক চালভেবেছিল। যাই হোক, সে আক্রমণের জন্য আমেরিকা আল-কায়েদা ও সেটার নেতা ওসামা বিন লাদেনকে দোষী সাব্যস্ত করল। আল কায়দা তথা ওসামা বিন লাদেনকে যুক্তরাষ্ট্র তৈরি করেছিল ১৯৭৯ সালে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন ছিল ওসামা বিন লাদেনকে। আজ সেই প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। যেহেতু আল-কায়েদার নেটওয়ার্ক আফগানিস্তানে ছিল, সেই সুযোগে আমেরিকা বিন লাদেনকে খতম করার ওজুহাতে এক মাসের মধ্যে আফগানিস্তানে হামলা চালালো এবং আফগানিস্তানে নিরীহ সাধারণ ও বেসামরিক মানুষের উপর নির্মম অত্যাচার, নির্যাতন চালালো। বিন লাদেনকে খুঁজে বের করার ওজুহাতে আমেরিকার পিশাচ বাহিনী আফগানিস্তানের ঘরে ঘরে মুসলমানদের গণহত্যা শুরু করল। এমনই এক হাস্যকর ওজুহাতে তারা চরম এক বেদনাদায়ক অবস্থার অবতারণা করল।

আমেরিকা-আফগান যুদ্ধঃ

৯/১১ এর পর শুরু হওয়া সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের আওতায় মার্কিন বাহিনী ৭ অক্টোবর, ২০০১ সালে আফগানস্থান আক্রমণ করে। এসময় ব্রিটিশ সেনারাও তাদের সহযোগী হিসেবে সেখানে যোগ দেয়। মার্কিন ও ব্রিটিশ যৌথ বাহিনী, স্থানীয় তালেবান বিরোধী উত্তরাঞ্চলীয় জোটের সহায়তায় তালেবানদেরকে কোণঠাসা করে আফগানস্থানের নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হয়। ২০০১ সালের ডিসেম্বর মাসে জাতিসংঘের নেতৃত্বাধীন ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাসিস্টানস ফোর্স (ইসাফ) আফগানস্থানের রাজধানী কাবুলসহ আশেপাশের এলাকার নিরাপত্তা দায়িত্বভার গ্রহণ করে। বিশ্বের ৪২টি দেশের সৈন্যরা এই ফোর্সে রয়েছে। ২০০৯ সালের জুলাইয়ে ন্যাটো এই ফোর্সের দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে সব মিলিয়ে প্রায় দেড় লক্ষ বিদেশী সৈন্য সে দেশে রয়েছে।
২০০৫ এবং ২০০৬ সালে তালেবানরা আবার সংগঠিত হয়৷ ২০০৬ সালে তালেবানেরা পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করে যুদ্ধের ময়দানে হাজির হয়। সেই থেকে প্রায় প্রতিদিনই আফগানস্থানে বিদেশী সৈন্যদের হতাহতের খবর আসছে।
…………………

আফগানিস্তান যুদ্ধে মুসলিম নির্যাতনঃ

আফগানিস্থানে নামমাত্র সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হবার পর থেকে এসময় জুড়ে প্রাণ হারিয়েছে প্রায় ৫০,০০০ নিরীহ মানুষ। গণমাধ্যমে বারবার এসেছে বিদেশী সেনাদের হাতে মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা। সমপ্রতি উইকিলিকস-এর কল্যাণে ফাঁস হওয়া গোপন মার্কিন দলিলপত্রেও বিদেশী সৈন্যদের হাতে পাইকারি হারে নিরীহ আফগান নাগরিক নিহত হবার বিভিন্ন ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়। এসব কারণে সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ড- আফগানস্থান থেকে তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নিয়েছে। পোলান্ড এবং কানাডাও সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছে। গত একমাসে বেশ কিছু অস্ট্রেলীয় সেনা নিহত হবার পর অস্ট্রেলিয়াও সেনা প্রত্যাহারের কথা ভাবছে।

গুয়ানতানামো কারাগার:

গুয়ানতানামো কারাগার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি কারাগার যা বন্দীদের ওপর অমানুষিক নির্যাতনের জন্য কুখ্যাত। এই কারাগারে বন্দীদের বিনাবিচারে আটক রাখা হয় এবং তথ্য আদায়ের লক্ষ্য নিয়ে বন্দীদের ওপর 'ওয়াটার বোর্ডিং'-সহ বিবিধ আইনবহির্ভূত উপায়ে নির্যাতন চালানো হয়। নির্যাতনের প্রকার ও মাত্রা এতই বেশী যে এই কারাগারকে মর্ত্যের নরকবলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ সত্বেও এই কারাগারটিকে অব্যাহতভাবে নির্যাতনের জন্য ব্যবহার করতে থাকায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে একে মার্কিনীদের লজ্জাহিসাবে অভিহিত করা হয়েছে।
এই কারাগারটি ২০০২ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূ-খণ্ডের বাইরে কিউবার দক্ষিণ-পূর্ব পাশে ক্যারিবীয় সাগরে এর অবস্থান। ১৪ই জানুয়ারী ২০১২ তারিখে প্রকাশিত আল জাজিরা টেলেভিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ৮০০ জন বন্দীকে মুক্তি দেয়ার পর এ কারাগারে বিভিন্ন দেশের ১৭১ জন বন্দী আটক আছে। এই কারাগারে মার্কিন-বিরোধী তৎপরতায় সংশ্লিষ্ট জঙ্গী, সন্ত্রাসী ও গুপ্তচর সন্দেহে বিভিন্ন দেশের নাগরিককে আটক রাখা হয়। এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে এই বন্দীশালায় বিনা বিচারে আট বৎসর আটক থাকার পর ১৯৮ জনের মধ্যে ১৩০ জনেরও বেশি বন্দী নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন। এ পর্যন্ত মাত্র ৬ জন বন্দীকে বিচারের মাধ্যমে দোষী সাব্যস্ত করা সম্ভব হয়েছে।

………………….

আমেরিকার যুদ্ধ-ব্যয়

যেখানে খোদ যুক্তরাষ্ট্র বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন (প্রতি ৬ জনের মাঝে ১ জন বেকার। ৪ কোটি ৬২ লাখ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে), সেখানে যুক্তরাষ্ট্র তার সামরিক কর্তৃত্ব বজায় রাখতে আফগানিস্তানে প্রতি বছর ব্যয় করছে ১০০ বিলিয়ন ডলার, বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ প্রায় ৭৮০০০০ কোটি টাকার সমান। আর যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ শুরু করেছে, তাতে খরচ ধরা হয়েছে ৩ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার। কারো কারো মতে এই খরচের পরিমাণ ৬ ট্রিলিয়ন ডলার। বিশেষ করে লিবিয়ার যুদ্ধের পেছনে যে খরচ হয়েছে, তা যোগ করলে ৬ ট্রিলিয়ন ডলার হবে। অথচ এই টাকা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে নতুন করে চাকরির সংস্থান করা যেত। স্বাস্থ্যবীমার আওতায় আনা যেত ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে। স্কুলগুলোতে শিক্ষকের সংখ্যাও বাড়ানো যেত। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তা করেনি। বরং যুদ্ধের জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করেছে। গেল সপ্তাহে যুদ্ধের অস্বাভাবিক খরচ নিয়ে ওয়াশিংটনে একটি সংগঠন ঙপঃড়নবৎ ২০১১ ঙৎম গড়াবসবহঃ বড় ধরনের বিক্ষোভ করেছে। তারা চাচ্ছে এই অর্থ সামাজিক খাতে ব্যয় করতে।
যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের যে সূচনা করেছে, তা নিয়ে গবেষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়। তাদের হিসাবে খরচের পরিমাণ ৩ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার। পেন্টাগনের হিসাব মতে প্রতি মাসে আফগানিস্তান ও ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের খরচ ৯ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার (যার মাঝে ৩ ভাগের ২ ভাগ খরচ হয় আফগানিস্তানে)। প্রশিক্ষণ, অস্ত্রশস্ত্র ও ড্রোন বিমান হামলা চালাতে এই খরচ হয়। অথচ যুক্তরাষ্ট্রকে মহাশূন্যে একটি সাটল মহাকাশ যান পাঠাতে খরচ হয়েছিল ১ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার। পেন্টাগন ইরাক ও আফগানিস্তানে গত ৪০ মাসে খরচ করেছে ৩৮৫ মিলিয়ন ডলার, যা কী না বয়োজ্যেষ্ঠদের স্বাস্থ্যবীমাখাতে যুক্তরাষ্ট্র খরচ করেছে গত ১০ বছরে। গবেষণায় দেখা গেছে শুধুমাত্র সেনাদের ব্যবহৃত গাড়ির জ্বালানি তেল (আফগানিস্তান) বাবদ ৯ অক্টোবর ২০১০ থেকে মে ২০১১) যুক্তরাষ্ট্র খরচ করেছে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। যদি যুুদ্ধক্ষেত্রে তেল সরবরাহ ও জনশক্তির খরচ হিসাব করা হত, তাহলে প্রতি গ্যালন তেলের মূল্য গিয়ে দাঁড়াত ১০০ ডলারে। প্রতি বছর সেখানে, অর্থাৎ আফগানিস্তানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বজায় রাখতে (শুধু সেনাদের জন্য) যুক্তরাষ্ট্রের খরচ হয় বছরে ২০ বিলিয়ন ডলার। ২০০৯ সালে আফগানিস্তানে প্রতি মার্কিন সেনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের খরচ ছিল ৫০৭০০০ ডলার (বছরে)। ২০১০ সালে এটা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৬৬৭০০০ ডলারে। আর ২০১১ সালে এই খরচ গিয়ে দাঁড়াবে ৬৯৪০০০ ডলারে। এটা কংগ্রেশনাল রিপোর্ট। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ইরাকে ২০০৭ সালে প্রতি মার্কিন সেনার জন্য বছরে খরচ ছিল ৫১০০০০ ডলার, আর ২০১১ সালে তা বেড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৮০২০০০ ডলারে। ২০১১ সালে কংগ্রেস আফগানিস্তানে যুদ্ধের খরচের জন্য বরাদ্দ দিয়েছে ১১৩ বিলিয়ন ডলার। ইরাকের জন্য বরাদ্দ ৪৬ বিলিয়ন (২০১২ সালের জন্য বরাদ্দ কিছুটা কমেছে ১০৭ বিলিয়ন ও ১১ বিলিয়ন ডলার)। বলা ভালো, ইরাক থেকে ক্যাম্পবেট ট্রুপসঅর্থাৎ যুদ্ধরত সৈন্যদের প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। প্রায় ৫০ হাজার সৈন্য রয়ে গেছে, যারা শুধুমাত্র প্রশিক্ষণ কাজে নিয়োজিত। অন্যদিকে ওবামা ঘোষণা করেছেন ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে সকল মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়া হবে। (ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার জন্য দেখুন গপ পষধঃপযু ঘবংিঢ়ধঢ়বৎ-এর প্রতিবেদন ১৫ আগস্ট, ২০১১)।
যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধচালিয়ে যাবার জন্য যে বিপুল অর্থ ব্যয় করছে, তা দিয়ে সামাজিকখাতে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারত। যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানের জন্য যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করেছে (১১৩ বিলিয়ন, ২০১১-১২), সেই পরিমাণ অর্থ দিয়ে (ক) ৫৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন শিশুর (নিম্ন আয়ের পরিবারের) স্বাস্থ্য সেবা, (খ) ২৩ মিলিয়ন নিম্ন আয়ের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা, (গ) ২০২ মিলিয়ন ছাত্রের বৃত্তি, (ঘ) ১৪ দশমিক ৩৫ মিলিয়ন বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবা, (ঙ) বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ১৪ দশমিক ২৬ মিলিয়ন ডলার আর্থিক সহয়তা নিশ্চিত করা সম্ভব। সেই সাথে প্রাথমিক স্কুলে ১ দশমিক ৭৫ মিলিয়ন স্কুল শিক্ষক, ১ দশমিক ৬৫ মিলিয়ন পুলিশ অফিসার ও ৬৭ দশমিক ৮ মিলিয়ন অর্থ দিয়ে সোলার প্যানেল বসানো সম্ভব।
আফগান শরণার্থীঃ
চিত্রঃ আফগানিস্তান (লাল রঙে নির্দেশিত), বেশিরভাগ শরণার্থী দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল দিয়ে পাকিস্তানে ও পশ্চিমাঞ্চল দিয়ে ইরানেপ্রবেশ করে। সোভিয়েত সৈন্যবাহিনী উত্তর পাশ দিয়ে আফগানিস্তানে প্রবেশ করেছিলো।

আফগান শরণার্থী (ইংরেজি: Afghan refugees) যা দক্ষিণ এশিয়ায় মুহাজির আফগান নামেও পরিচিত। আফগান শরণার্থী বলতে তাঁদেরই বোঝানো হয় যাঁরা ১৯৭৯ সালে সংঘটিত সোভিয়েত যুদ্ধ ও পরবর্তীতে আফগান গৃহযুদ্ধের ফলে তাঁদের ঘর-বাড়ি হারিয়ে শরণার্থী হয়েছেন। ১৯৮০-এর দশক থেকে প্রায় ৩০ লক্ষ আফগান শরণার্থী পাকিস্তানে এবং প্রায় ২০ লক্ষ শরণার্থী ইরানে আশ্রয় নিয়েছেন। এছাড়াও আরও অনেকে উত্তর আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশসমূহে, অস্ট্রেলিয়া, ও বিশ্বের অন্যান্য দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। বেশ কয়েক হাজার শরণার্থী ভারতেও আশ্রয় নিয়েছিলেন।
১১ সেপ্টেম্বর, ২০০১-এর ঘটনার পর মার্কিন সামরিক বাহিনী এবং ন্যাটো সৈন্যবাহিনী  তালিবানদের বিরুদ্ধে আফগানিস্তানে যুদ্ধ শুরু করে, এবং এই যুদ্ধের শিকার হয়ে আরো বেশ কয়েক লক্ষ মানুষ আফগানিস্তান ত্যাগ করে শরণার্থী হন। ২০০১ সালের শেষ দিকের হিসাব অনুযায়ী পায় ৫০ লক্ষ আফগান, শরণার্থী হিসেবে পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছেন। এই সম সংখ্যক আফগানের জন্ম হয়েছিলো গত বিশ বছরে। আছাড়াও এই যুদ্ধের কারণে প্রায় ২৪ লক্ষ শরণার্থী ইরানে আশ্রয় নিয়েছে, যার ফলে সর্বমোট শরণার্থীর সংখ্যা দাড়ায় প্রায় ৭৫ লক্ষ।
২০০২ সালের শুরু থেকে প্রায় ৫০ লক্ষ আফগান শরণার্থী জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন ইউনাইটেড নেশন্‌স হাই কমিশনার ফর রেফ্যুজিসের(ইউএনএইচসিআর) মাধ্যমে পাকিস্তান ও ইরান থেকে তাঁদের মূল বাসভূমি আফগানিস্তানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

বিভিন্ন মহলের মতামতঃ

আফগান যুদ্ধ ভিয়েতনাম যুদ্ধের ভাগ্যবরণ করতে পারে বলে আশংকা জোরালো হচ্ছে। কেউ কেউ আবার বলছেন, সোভিয়েত বাহিনীর মতো মার্কিন বাহিনীও আফগানিস্তান থেকে লজ্জা মাথায় নিয়ে পিছু হটতে বাধ্য হবে। যুক্তরাষ্ট্রের কোন কোন সরকারী কর্মকর্তাও আফগান যুদ্ধকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সাথে তুলনা করেছে। আফগানিস্তান বিষয়ক মার্কিন বিশেষ দূত হলব্রুক নিজেও এ ধরনের মন্তব্য করেছে। সে একটি জার্মান দৈনিকের সাথে সাক্ষাতকারে বলেছেন, আফগানিস্তান যুদ্ধ ভিয়েতনাম যুদ্ধের চেয়েও কঠিন ও জটিল। সে আরও বলেছে, ভিয়েতনাম যুদ্ধের চেয়েও আফগান যুদ্ধ দীর্ঘতর হতে পারে এবং তা মার্কিন ইতিহাসের দীর্ঘতম যুদ্ধে পরিণত হতে পারে। তিনি বলেন, আফগান যুদ্ধ হচ্ছে মার্কিন ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন যুদ্ধ এবং এ পর্যন্ত কোন শত্রুর মোকাবেলা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে এত বেশি বেগ হতে হয়নি। ১৯৫৯ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত চলা ভিয়েতনাম যুদ্ধে প্রায় ৫৮ হাজার মার্কিন সেনা দেশটির নেতৃবৃন্দের আধিপত্যকামী নীতির বলি হয়েছিল। ভিয়েতনামের জনগণ মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে ইস্পাত কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তুলে আগ্রাসীদের দেশ ত্যাগে বাধ্য করে। সে সময় মার্কিন বাহিনীর হাতে ১১ লক্ষ ভিয়েতনামী নিহত ও ছয় লক্ষ আহত হয়। মার্কিন সরকার ভিয়েতনামে কমিউনিজম মোকাবেলার কথা বলে সেখানে সৈন্য পাঠিয়েছিল। মার্কিন সরকার বর্তমান যুগে এসে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অভিযান ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অজুহাতে আফগানিস্তানে যুদ্ধ অব্যাহত রেখেছে।

কাফিরদের পলায়নঃ

প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ২০০৯ সালে হোয়াইট হাউসে আসার পর বলে যে, আফগান যুদ্ধের লক্ষ্য হল, তালেবানরা আবার যতোটুকু কায়েম হয়ে বসেছে, তাদের সেখান থেকে বিচ্যুত করা - এবং স্বভাবতই আল-কায়েদা'কে ‘‘বিধ্বস্ত, পরাজিত ও বিলুপ্ত'' করা৷ আফগানিস্তানে ২০১০ সালে ৬৮ হাজার মার্কিন সেনা ছিল এবং বারাক ওবামা আরও ৩০ হাজার সেনা মোতায়েনের নির্দেশ জারি করেছিল।
সে কাজ সমাপ্ত হয়নি তো বটেই, এই পন্থায় সমাপ্ত হবে কিনা, তা নিয়েও সন্দেহ দেখা দেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র এবং অপরাপর ন্যাটো দেশ ২০১৪ সালের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে কমব্যাট বা যুদ্ধ সৈনিকদের সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে৷ তার পটভূমিতে রয়েছে আফগানিস্তানে বিদেশী সৈন্যদের বিপুল জীবনহানি৷ এই দশ বছরে শুধু মার্কিন সৈন্যই নিহত হয়েছে প্রায় আঠেরো', আহতের সংখ্যা পনেরো হাজারের বেশি৷
মার্কিন সামরিক রিপোর্ট অনুযায়ী আফগানস্থানে এ পর্যন্ত প্রায় ২১০০ বিদেশী সেনা নিহত হয়েছে, যার মধ্যে ২০১০ সালেই মারা গেছে ৫৪১ জন, আহত হয়েছে প্রায় ১২৫০০। এছাড়া এ সময়ে আফগান বাহিনীর প্রায় ৭০০০ সেনা প্রাণ হারিয়েছে। (তবে গণমাধ্যমের হিসেব অনুযায়ী হতাহতের এ সংখ্যা আরো বেশি)। সময় গড়ানোর সাথে সাথে নিহতের সংখ্যাটিও ক্রমেই বড় হচ্ছে।

সূত্রঃ

১) http://en.wikipedia.org/wiki/War_in_Afghanistan_(2001%E2%80%93present)


[বিঃদ্রঃ তথ্য প্রদানে কোন ভুল থাকলে দয়া করে মেইল করে জানাবেন]

[ট্যাগঃ পীর-মুরীদি (মুরিদি) ব্যবসাধারী ভন্ড-পীর সহ ধর্মব্যবসায়ীদের জম রাজারবাগ দরবার শরীফ, রাজারবাগী পীর সাহেব কিবলা আলাইহিস সালাম]