নোটিশ

শনিবার, ৪ আগস্ট, ২০১২

মুসলিম নির্যাতন (১২)- মায়ানমার বা বার্মার আরাকান রাজ্যে মুসলিম গণহত্যা ও নির্যাতনের নির্মম ইতিহাস

আরাকান রাজ্যের রোহিঙ্গা ও তাদের ইতিহাসঃ


রোঁয়াই, রোহিঙ্গা এবং রোসাঙ্গ শব্দগুলো পরিমার্জিত হয়ে বাঙালি কবিদের কাছে রোসাঙ্গ হিসেবে প্রকাশ পেয়েছে এবং স্থানীয় জনগণের কাছে রোয়াং হিসেবে পরিচিত হয়েছে।
রোয়াং কিংবা রোসাঙ্গ শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে বিশেষজ্ঞগণ নানা মত পোষণ করে থাকেন।
কিছু ঐতিহাসিক মনে করে থাকেন, ‘আরাকানের পূর্বতন রাজধানী ম্রোহং শব্দটি বিকৃত হয়ে রোয়াং, রোহাংগ, রোসাংগ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। চট্টগ্রামীদের কাছে, এমনকি আরাকানের রোহিঙ্গাদের কাছে ম্রোহাং পাথুরী কিল্লা বলে পরিচিত।
১৪০৪ খ্রিস্টাব্দে নরমিখলা নামে আরাকানের জনৈক যুবরাজ মাত্র ২৪ বছর বয়সে পিতার সিংহাসনে আরোহণ করেন। রাজধানী ছিলো লেম্ব্রো নদীর তীরে লংগ্রেত। সিংহাসনে আরোহণ করেই নরমিখলা একজন দেশীয় সামন্তরাজার ভগ্নিকে অপহরণ করে রাজধানী লংগ্রেতে নিয়ে আসেন। ফলে আরাকানের সামন্তরাজাগণ একত্রিত হয়ে বার্মার রাজা মেঙশো আইকে আরাকান দখল করার জন্য অনুরোধ জানান। ১৪০৬ খ্রিস্টাব্দে বার্মার রাজা ত্রিশ হাজার সৈন্য নিয়ে আরাকান আক্রমণ করলে নরমিখলা পালিয়ে তদানিন্তন বাংলার রাজধানী গৌড়ে এসে আশ্রয় নেন। তখন ইলিয়াস শাহী রাজবংশ গৌড় থেকে বাংলা শাসন করতো।
জনশ্রুতি রয়েছে, নরমিখলা গৌড়ে এসে সুফী হযরত মুহম্মদ জাকির রহমতুল্লাহি আলাইহি নামক জনৈক বিখ্যাত কামিল ব্যক্তির দরবার শরীফ-এ আশ্রয় নেন।
নরমিখলা সুদীর্ঘ চব্বিশ বছরকাল গৌড়ে অবস্থান করেন এবং ইসলামের ইতিহাস, সভ্যতা ও রাজনীতি অধ্যয়ন করেন। “He turned away from what was Buddhist and familiar to what was Muslim.”
চব্বিশ বছর পর ১৪৩০ খ্রিস্টাব্দে গৌড়ের সুলতান নাসিরউদ্দিন শাহ মতান্তরে জালালুদ্দিন শাহ সেনাপতি ওয়ালী খানের নেতৃত্বে বিশ হাজার সৈন্যবাহিনী দিয়ে নরমিখলাকে স্বীয় রাজ্য আরাকান উদ্ধারের জন্যে সাহায্য করেন।
উল্লেখ্য, নরমিখলা ইতোমধ্যে নিজের বৌদ্ধনাম বদলিয়ে মুহম্মদ সোলায়মান শাহ নাম ধারণ করেন। ফলে বার্মার ইতিহাসে তিনি মুহম্মদ সোলায়মান (মংস মোয়ান) হিসেবে পরিচিত লাভ করেন। গৌড়ীয় সৈন্যের সহায়তায় নরমিখলা ওরফে সোলায়মান শাহ আরাকান অধিকার করে ম্রাউক-উ নামক এক রাজবংশের প্রতিষ্ঠান করেন। আর এ সাথে শুরু হয় বঙ্গোপসাগরে উপকূলে এক শ্রেষ্ঠ সভ্যতার।

“In this way Arakan became definitly oriented towards the Moslem states, contact with a modern Civili“ation resulted in renaissance. The Country’s great age began.”
অর্থাৎ- এভাবে আরাকান নিশ্চিতভাবে মুসলিম রাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকে পড়ে, একটি আধুনিক সভ্যতার সাথে এই সম্পর্ক আরাকানে এনে দেয় এক রেনেসাঁ। আরাকানী জাতির এক মহাযুগ শুরু হয়।
১৪৩০ খ্রিস্টাব্দে সেনাপতি ওয়ালী খানের নেতৃত্বে নরমিখলা ওরফে সোলায়মান শাহ আরাকান অধিকার করার এক বছরের মধ্যে ওয়ালী খান বিদ্রোহ করে নিজেই আরাকান দখল করে নিলে পর গৌড়ের সুলতান জালালুদ্দিন শাহ সেনাপতি সিন্ধিখানের নেতৃত্বে আবার ত্রিশ হাজার সৈন্য পাঠিয়ে সোলায়মান শাহকে (নরমিখলা) সাহায্য করেন। সিন্ধি খানের নামে একটি মসজিদ এখনো ম্রোহং বা পাথুরী কিল্লাতে রয়েছে। অতঃপর সকল গৌড় থেকে আগত সৈন্যরা আরাকানেই বিশেষ রাজকীয় আনুকূল্যে স্থায়ী বসতি গড়ে তোলেন। ১৪৩২ খ্রিস্টাব্দে সিন্ধি খানের সহযোগিতায় সোলায়মান শাহ পিতার রাজধানী লংগ্রেত থেকে ম্রোহং নামক স্থানে স্বীয় প্রতিষ্ঠিত ম্রাউক-উ বংশের রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। ১৪৩০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আরাকান গৌড়ের সুলতানদের কর প্রদান করতো।
১৫৩১ খ্রিস্টাব্দে গৌড়ের অভ্যন্তরীণ গোলযোগের সুযোগে সোলায়মান শাহর দ্বাদশতম অধঃস্তন পুরুষ জেবুক শাহ (মিনবিন) ম্রোহং-এর সিংহাসনে আরোহণ করে পূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণা এবং এবং জেবুক শাহের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় ম্রাউক-উ-সাম্রাজ্য।
“With him (Zabukshah) the Arakanese graduated in their Moslem studies & the Empire was founded. উল্লেখ্য, ১৪৩০ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শেখের কিছু কাল বাদ দিলে আরাকান ম্রাউক-উ রাজবংশের শাসনাধীন ছিলো। এ সময়ে প্রায় প্রত্যেক রাজা নিজেদের বৌদ্ধ নামের সাথে একটি মুসলিম নাম ব্যবহার করেছেন। ফারসী সরকারি ভাষা হিসেবে চালু হয়। গৌড়ের মুসলমানদের অনুকরণে মুদ্রা প্রথার প্রবর্তন হয়। মুদ্রার একপিঠে রাজার মুসলিম নাম ও অভিষেক কাল এবং অপরপিঠে মুসলমানদের কালিমা শরীফ আরবী হরফে লেখা হয়।

রাজার সৈন্যবাহিনীতে অফিসার থেকে সৈনিক পর্যন্ত প্রায় সবাইকে মুসলমানদের মধ্য থেকে ভর্তি করানো হতো। মন্ত্রী পরিষদের অধিকাংশই মুসলমান ছিলো। কাজী নিয়োগ করে বিচারকার্য পরিচালিত হতো।

অপর এক রাজা সেলিম শাহ বার্মার মলমিন থেকে বাংলার সুন্দরবন পর্যন্ত বিরাট ভূভাগ দখল দিল্লির মোঘলদের অনুকরণে নিজেকে বাদশাহ উপাধিতে ভূষিত করেন। নিঃসন্দেহে তদানিন্তন শ্রেষ্ঠ সভ্যতা তথা মুসলিম আচার-আচরণ অনুকরণে এসে আরাকানের সমাজ জীবন পরিচালিত হয়েছে সুদীর্ঘ প্রায় চারশবছরকাল। যাকে রোসাঙ্গ সভ্যতা হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে।

এদিকে খ্রিস্টীয় ৮ম/৯ম শতাব্দীতে চন্দ্র বংশীয় রাজারা আরাকান শাসন করতো। উজালী ছিলো এ বংশের রাজধানী। বাংলা সাহিত্যে যা বৈশালী নামে খ্যাত। এ বংশের উপাখ্যান রাদ জাতুয়েতে নিম্নরূপ একটি আখ্যান উল্লেখ আছে। কথিত আছে, এ বংশের রাজা মহত ইং চন্দ্রের রাজত্ব কালে (৭৮৮-৮১০ খ্রিস্টাব্দ) কয়েকটি বাণিজ্য বহর রামব্রী দ্বীপের তীরে এক সংঘর্ষে ভেঙে পড়ে। জাহাজের আরবীয় আরোহীরা তীরে এসে ভিড়লে পর রাজা তাদের উন্নততর আচরণে সন্তুষ্ট হয়ে আরাকানে বসতি স্থাপন করান। আরবীয় মুসলমানগণ স্থানীয় রমণীদের বিয়ে করেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। জনশ্রুতি আছে, আরবীয় মুসলমানেরা ভাসতে ভাসতে কূলে ভিড়লে পর রহম’ ‘রহমধ্বনি দিয়ে স্থানীয় জনগণের সাহায্য কামনা করতে থাকে।

বলাবাহুল্য, ‘রহমএকটি আরবী শব্দ। যার অর্থ দয়া করা। কিন্তু জনগণ মনে করে এরা রহম জাতির লোক। রহম শব্দই বিকৃত হয়ে রোয়াং হয়েছে বলে রোহিঙ্গারা মনে করে থাকেন। সুপ্রসিদ্ধ আরব ভৌগোলিক সুলায়মান ৮৫১ খ্রিস্টাব্দে রচিত তার বিখ্যাত গ্রন্থ সিলসিলাত উত তাওয়ারীখ; নামক গ্রন্থে বঙ্গোপসাগরের তীরে রুহমী নামক একটি দেশের পরিচয় দিয়েছেন। যাকে আরাকানের সাথে সম্পর্কযুক্ত মনে করা যেতে পারে।

কক্সবাজারের টেকনাফ থানায় শাহপরীর দ্বীপ বলে একটি স্থান রয়েছে। টেকনাফের অদূরে আরাকানের মংডু শহরের সন্নিকটস্থ সুউচ্চ দুটি পাহারের চূড়ার একটির নাম হানিফার টংকী এবং পাশ্ববর্তী অপরটি কায়রা পরীর টংকী বলে খ্যাত। আরাকানে জনশ্রুতি আছে, ইসলামের চতুর্থ খলীফা হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু আলাইহিস সালাম উনার ছেলে হযরত মুহম্মদ হানিফা রহমতুল্লাহি আলাইহি ইয়াজীদের সাথে দন্দ্ব হওয়ার কারণে আরাকানে আসেন এবং ইসলাম প্রচার করেন। কারবালার বিয়োগান্তক ঘটনার পর ইতিহাসে হযরত মুহম্মদ হানিফা রহমতুল্লাহি আলাইহি সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য কিছু জানা যায়নি।
অপরদিকে বঙ্গোপসাগরীয় উপকূল হতে দক্ষিণপূর্ব এশিয়া পর্যন্ত তৎকালীন সময়ের পূর্ব হতেই আরব বণিকদের যোগাযোগ থাকার প্রমাণ ইতিহাসে ভূরি ভূরি রয়েছে।
কক্সবাজার জেলায় বসবাসকারী জনগণ সাধারণ নিজেদের আরব বংশোদ্ভূত বলে মনে করে থাকেন। এই এলাকার জনগণের ভাষায় ক্রিয়াপদের পূর্বে না সূচক শব্দ ব্যবহার আরবী ভাষার প্রভাবের ফল বলে পন্ডিতগণের ধারণা। কক্সবাজারের জনগণের ভাষায় প্রচার আরবী ও ফারসী শব্দ এবং মঘী শব্দের আধিক্য দেখা যায়। মঘী জরিপের অনুরূপ অত্র এলাকার জমির পরিমাণ দ্রোন, কানী ও গণ্ডা ইত্যাদি হিসেবে হয়ে থাকেন। অপরপক্ষে বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে গৌড়ীয় পরিমাপ অনুসারে বিঘা, কাঠা ও পাখি হিসেবে হয়ে থাকে।

নিঃসন্দেহে কক্সবাজারের জনগণের উপর এটি রোসাঙ্গ সভ্যতার প্রভাবের ফল। অনেক ডাক ও পর্তুগীজ শব্দও জনগণের ভাষায় পরিলক্ষিত হয়। আরো দেখা যায়, পর্তুগীজ নাম ফারনানডেজ বিকৃত হয়ে পরান মিয়া, ম্যানুয়েল বিকৃত হয়ে মনু মিয়া হয়েছে।

অনেক ডাচ পর্তুগীজ সন্তান ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হয়েছে- এমন ঘটনা নিয়ে একটি গল্প ডাচ ইতিহাসে পাওয়া যায়। ঘটনাটি হলো- আরাকানের ম্রাউক-ই রাজবংশের রাজত্বকালে কোন বিদেশী ইচ্ছা করলে আরাকানী রমণীদের বিয়ে করতে পারতো। কিন্তু আরাকান থেকে চলে যাওয়ার সময় আরাকানী স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে যেতে পারতো না।

“This prohibition often constituted a serious hardship in individual cases and we find Europeans resorting to all sorts of expedients to smuggle their families out of the country. There were cases of wives being hidden in large martaban jars and Smuggled on board ship. The Pious Dutch Calvinists were also not a little worried because their children left in Arakan were brought up to be Muslims.

অর্থাৎ- আরাকানে অবস্থানরত ডাচগণের ফেলে যাওয়া সন্তান-সন্তুতি মুসলমান হয়ে যায় বিধায় চলে যাওয়ার সময় বড় বড় মটকায় স্ত্রী-পুত্রদের লুকিয়ে আরাকান থেকে নিয়ে যেত। এ ঘটনাটি নিঃসন্দেহে তদানিন্তন আরাকানের সামাজিক সাংস্কৃতিক অবস্থান কেমন ছিল তা জানতে আমাদের সাহায্য করে। অর্থাৎ ইসলামই ছিলো তৎকালীন আরাকানের সমাজ জীবনে মূল প্রভাব বিস্তারকারী শক্তি। মহাকবি আলাওল পদ্মাবতী কাব্যে রোসাঙ্গের জনগোষ্ঠীর একটি পূর্ণাঙ্গ বিবরণ দিয়েছেন, “নানাদেশী নানা লোক শুনিয়া রোসাঙ্গ ভোগ আইসন্ত নৃপ ছায়াতলে। আরবী, মিশরী, সামী, তুর্কী, হাবসী ও রুমী, খোরসানী, উজবেগী সকল। লাহোরী, মুলতানী, সিন্ধি, কাশ্মীরী, দক্ষিণী, হিন্দি, কামরূপী আর বঙ্গদেশী। বহু শেখ, সৈয়দজাদা, মোগল, পাঠান যুদ্ধা রাজপুত হিন্দু নানাজাতি। (পদ্মাবতী : আলাওল)

সন্দেহের অবকাশ নেই যে, রোহিঙ্গারাই ইতিহাস প্রসিদ্ধ রোসাঙ্গ সভ্যতার ধারক বাহক। তবে এটুকু বলা চলে, নানা জাতির সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে এই রোহিঙ্গা জাতি।
১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে বার্মার রাজা আরাকান দখল করে নিলে পর আরাকানের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মগরা পালিয়ে আসে। এটাই যুক্তিসঙ্গত যে, বৌদ্ধদের সাথে সাথে মুসলমানরাও লাঞ্ছিত হতে থাকে। কোন স্থানে দুর্যোগ আসলে উক্ত এলাকায় বসবাসকারী প্রত্যেক অনুরূপ অত্যাচারের শিকার হতে বাধ্য।

অতএব, মগদের সাথে সাথে মুসলমানরাও চলে আসে। তবে তফাৎ হলো মগেরা পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয় গভীর জঙ্গলে আর মুসলমানেরা সমুদ্র পথে হিজরত করে এসে আশ্রয় নেয় স্বধর্মীয় চট্টগ্রামের মুসলমানদের কাছে। আরাকান থেকে আগত মুসলমান স্থানীয় মুসলমানদের কাছে এক বোঝা হয়ে দাঁড়ায় এবং এখান থেকেই শুরু হয় অতীতের রোয়াই ও চাড়িগ্রাই (চট্টগ্রামী) দুই জনগোষ্ঠীর বিবাদের ইতিহাস।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, রোঁয়াই শব্দটি রোসাঙ্গ হতে অভিন্ন। একই এলাকায় বসবাসকারী অধিবাসীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে ভিন্ন দুই ধরনের ভাষা হতে পারে না। যেমন একজন উখিয়া থানার বসবাসকারী লোককে একজন মহেশখালী থানায় বসবাসকারী লোক থেকে চেহারার কারণে পৃথক করে নেয়ার উপায় নেই। তবে একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে লোকটির পূর্বপুরুষ রোঁয়াই নাকি চাড়িগ্রাই (চট্টগ্রামী)।

আরো উল্লেখ করা যেতে পারে, বাঁশখালী থানার কোন লোককে রাউজান থানার কোন লোক থেকে চেহারার জন্যে আলাদা করে নেয়া যাবে না। কিন্তু বাঁশখালীর চট্টগ্রামী কোন পল্লীর লোককে রোঁয়াই পল্লীর লোক থেকে ভাষার কারণে আলাদা করে নেয়া যাবে।
মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানগণ বিশ্বের সবচেয়ে ভাগ্যাহত জনগোষ্ঠী। এককালে যাদের ছিল স্বাধীন রাষ্ট্র, ক্ষমতা ও প্রভাব প্রতিপত্তি এখন তারাই সন্ত্রাসী বৌদ্ধদের অমানুষিক নির্যাতনের শিকার। মিয়ানমারের মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভাগ্য বিড়ম্বনার ইতিহাস যে কাউকে তাড়িত করবে। এই উপমহাদেশ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় সর্বপ্রথম যে কয়টি এলাকায় মুসলিম বসতি গড়ে ওঠে, আরাকান তার মধ্যে অন্যতম। রোহিঙ্গারা সেই আরাকানী মুসলমানের বংশধর। এক সময় আরাকানে স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৪৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম শাসন দুইশ বছরেরও অধিককাল স্থায়ী হয়। ১৬৩১ সাল থেকে ১৬৩৫ সাল পর্যন্ত আরাকানে ব্যাপক দুর্ভিক্ষ হয়। এরপর মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে। ১৬৬০ সালে আরাকান রাজা থান্দথুধম্মা নিজ রাজ্যে আশ্রিত মোঘল সম্রাট শাহজাদা সুজাকে সপরিবারে হত্যা করে। এরপর শুরু হয় মুসলমানের উপর তার নিষ্ঠুর অমানবিক অত্যাচার নিপীড়ন। প্রায় সাড়ে তিনশ বছর মুসলমানদের কাটাতে হয় এই দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে।

১৭৮০ সালে বর্মী রাজা বোধাপোয়া আরাকান দখল করে নেয়। সেও ছিল ঘোর মুসলিম বিদ্বেষী। বর্মী রাজা ঢালাওভাবে মুসলিম নিধন করতে থাকে। ১৮২৮ সালে বার্মা ইংরেজদের শাসনে চলে যায়।
মুসলিম গণহত্যার সূত্রপাতঃ
তবে ১৯৩৭ সালে বার্মা স্বায়ত্তশাসন লাভের পর বৌদ্ধদের পরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ব্যাপক রূপ নেয় এবং তারা প্রায় ৩০ লাখ মুসলিম হত্যা করে। ১৯৪৮ সালে বার্মা স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভাগ্যের কোন পরিবর্তন ঘটেনি। তারা থেকে যায় ভাগ্য বিড়ম্বিত। স্বাধীন দেশের সরকার তাদেরকে নাগরিকত্ব দূরে থাক মানবিক অধিকারটুকুও দেয়নি।

নাসাকা বাহিনী ও বৌদ্ধদের হামলার শিকার হয়ে রোহিঙ্গা মুসলিমরা পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশসহ বিশ্বের আনাচে-কানাচে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। এরা বিশ্বের রাষ্ট্রহীন নাগরিক। ১৯৮২ সালে মিয়ানমারের সরকার রোহিঙ্গা মুসলিমদের নাগরিকত্ব বাতিল করে দেয় এবং সরকারিভাবে তাদেরকে সেখানে বসবাসকারীহিসেবে উল্লেখ করা হয়। তাদের ভোটাধিকার নেই। নেই কোন সাংবিধানিক ও সামাজিক অধিকার। নিজ দেশে পরবাসী তারা। তারা মিয়ানমারের অন্য প্রদেশে অনুমতি ছাড়া যেতে পারে না। এক সময় যেখানে রোহিঙ্গারা ছিল সংখ্যাগুরু আজ সেখানে তারা সংখ্যালঘু। রাখাইন বৌদ্ধদের সেখানে এনে মুসলিমদের সংখ্যালঘু বানানো হয়েছে।

নতুন করে ভয়াবহ মুসলিম নিধন অভিযান

যুগ যুগ ধরে মুসলিম নিধনের ধাবাহিকতায় গত ৩ জুন থেকে পূর্ব পরিকল্পিত ইতিহাসের নৃশংসতম এ গণহত্যা শুরু করেছে সন্ত্রাসী রাখাইন বৌদ্ধরা। রোহিঙ্গাদের হাতে বৌদ্ধ মহিলা নির্যাতনের অজুহাতে তারা এ গণহত্যার সূচনা করে। শুরুতেই কট্টরপন্থী সন্ত্রাসী বৌদ্ধরা ১০ জন রোহিঙ্গা মুসলিমকে শহীদ করে। গত রোববার দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য রাখাইনের তুয়ানগোকিতে এ হামলার ঘটনা ঘটে। এই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে মুসলিম রোহিঙ্গারা জুমুয়াবার বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ শুরু করলে ভয়াবহ দাঙ্গা বেঁধে যায়।

মিয়ানমারের আকিয়াব শহরের রামবী গ্রামের এক রাখাইন শিক্ষিকা কর্তৃক ছাত্র পিঠানোকে কেন্দ্র করে অভিভাবক ও শিক্ষকদের গালিগালাজ ও উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়, এতে এক শিক্ষিকা মারা যায়। এরই জের ধরে আকিয়াব শহর থেকে গাড়িযোগে একদল রোহিঙ্গা মুসলিম ইয়াঙ্গুন যাওয়ার পথে ৩ জুন টংগু নামক স্থানে পৌঁছলে রাখাইন যুবকেরা গাড়ির হেলপারসহ ১০ রোহিঙ্গা মুসলিমকে পিটিয়ে হত্যা করে। ড্রাইভার কৌশলে পালিয়ে গিয়ে টংবু ইমিগ্রেশনকে অবহিত করে।

নির্মম এ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে ও বিচারের দাবিতে ৫ জুন বাদ যোহর ও আছরের নামায শেষে মুসলমানরা ইয়াঙ্গুন শহরে বিক্ষোভ সমাবেশ করে। এ ঘটনায় মুসলিম অধ্যুষিত পুরো আরাকান রাজ্যে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় ইয়াঙ্গুনে শীর্ষ মুসলিম নেতারা বৈঠক করে। ৮ জুন শুক্রবারে জুমুয়ার নামাযে মুসলমানদের জমায়েত করে শান্ত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। উক্ত সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে ৮ জুন পুরো আরকানে জুমুয়ার নামাযে মুসল্লীরা সমবেত হতে থাকে। মংডু শহরের মসজিদে জুমুয়ার নামায চলাকালে মংডুয়ে বৌদ্ধদের ইউনাইটেড হোটেল থেকে মসজিদে ও মুসল্লীদের উপর পাথর নিক্ষেপ শুরু করে ।

অতঃপর রাখাইন বৌদ্ধরা সম্মিলিতভাবে মুসলিমদের উপর হামলা শুরু করে। হাজার হাজার মুসলমানদের শহীদ করা শুরু করে। মসজিদ-মাদরাসা, ঘর-বাড়ি পোড়ানো শুরু করে। সরকারি মদদে কারফিউ জারি করে সেনা, পুলিশ ও নাসাকা বাহিনীর উপস্থিতিতে রাখাইন বৌদ্ধরা মুসলমানদের গণহত্যা চালাচ্ছে। সংঘর্ষ ও অগ্নিকান্ডের ঘটনা চালাচ্ছে। সাম্প্রতিক এ দাঙ্গার যে খবরাখবর গণমাধ্যমে এসেছে তা খানিকটা একপেশে ও তথ্য গোপনের অপচেষ্টায় দুষ্ট বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষকরা। কারণ প্রকাশিত খবরে এ দাঙ্গার মূল ঘটনা আড়ালে চলে গেছে এবং দাঙ্গার প্রকৃত উৎসকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। বৌদ্ধদের প্রাধান্য থাকায় দেশটির প্রচারমাধ্যম তাদের নিয়ন্ত্রণে। মুসলমান বা রোহিঙ্গাদের তেমন খবরদারি নেই সেখানে।

এ সম্পর্কিত প্রতিবেদনে এক বার্মিজ নাগরিক বলেছে, রোহিঙ্গা হত্যা একটি ভালো কাজ। এদিকে যাদের বিরুদ্ধে সম্ভ্রমহরণের অভিযোগ আনা হয়েছে তাদের সঙ্গে সঙ্গেই গ্রেফতার করেছে পুলিশ। কিন্তু প্রতিশোধ নেয়ার নেশায় উন্মাতাল হয়ে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের উপর হামলা চালায় বৌদ্ধ রাখাইনরা। ধর্ষণের ঘটনাটি দুঃখজনক হলেও এর প্রতিশোধ এত নির্মম হতে হবে? আবার একই প্রশ্নে জর্জরিত রোহিঙ্গারাও। হামলার প্রতিবাদে তারা কেন সশস্ত্র সংঘাতের পথ বেছে নিল? এ প্রশ্ন দুটোর উত্তর খুঁজতে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের আশ্রয় নেয়ার কোন বিকল্প নেই। ধর্ম ও জাতিগত বুনিয়াদ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের মধ্যে এর উত্তর পাওয়া যাবে। মিয়ানমারের সাম্প্রতিক দাঙ্গার প্রকৃতি বিবেচনা করলে দেখা যায়, রোহিঙ্গারা সংখ্যালঘু হলেও তাদের সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। কিন্তু প্রকৃত সংখ্যা কখনও প্রকাশ করেনি মিয়ানমার সরকার। তাদের অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। এর প্রমাণ পাওয়া যায় জাতিসংঘ নিযুক্ত মিয়ানমারের বর্তমান প্রতিনিধি ইয়ে মিয়িন্ট অংয়ের উদ্ধৃতি থেকে।

সে মুসলমান ধর্মানুসারী রোহিঙ্গাদের বন্য ও বর্বরবলে উল্লেখ করেছে। তাছাড়া সেই ১৯৮২ সাল থেকে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের উদ্বাস্তু বলে ঘোষণা করে আসছে। তাদের দেশটির নাগরিকত্ব দেয়া হয় না। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, এরা বাংলাদেশ থেকে আগত বাঙালি আদিগোষ্ঠী। এদের সঙ্গে মিয়ানমারের কোন সম্পর্ক নেই। সে মতামত প্রতিষ্ঠা করতে মিয়ানমার সরকার তাদের উপর এমন অমানবিক নির্যাতন চালায়, যাতে করে তারা দেশ ছেড়ে পালায় অথবা দাসত্ব স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়। এদের এ নাজুক পরিস্থিতি দেখে মেডিসিনস স্যান ফ্রন্টিয়ারস বলেছে, পৃথিবী থেকে বিলুপ্তপ্রায় আদিগোষ্ঠীর তালিকায় ভয়াবহ অবস্থানে রয়েছে রোহিঙ্গারা। এছাড়া সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠার পর রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীসহ মিয়ানমারের সব মিলিয়ে ১৩৫টি আদিবাসী গোষ্ঠীর উপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে চলেছে। তবে বৌদ্ধ ধর্মান্ধ সামরিক জান্তাদের চোখে রোহিঙ্গা মুসলমানরা ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীতে পরিগণিত হয়।

ফলে রাষ্ট্রের শাসন ক্ষমতায় মুসলমান আদিগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ ঠেকাতে তাদের ঘরবাড়ি পর্যন্ত পুড়িয়ে দেয়া হয়। রোহিঙ্গাদের সাধারণত স্থানীয়ভাবে কালারসনামে অভিহিত করা হয়। সাম্প্রতিক এ দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমারের দ্য ভয়েসনামক সাময়িকীতে প্রকাশিত একটি লেখা থেকে উদ্ধৃতি দেয়া যেতে পারে। সেখানে একজন পাঠক তার মতামত দিতে গিয়ে লিখেছে, আমাদের উচিত কালারস হত্যা করা অথবা ধ্বংস করা, তা না হলে এ দেশ থেকে বৌদ্ধ ধর্মের অস্তিত্ব মুছে যাবে। এমন উদ্ধৃতি থেকে সহজেই বোঝা যায়, বার্মিজ ও রোহিঙ্গারা ধর্মগত দিক থেকে দ্বান্দ্বিক ও পৃথক সত্তার অধিকারী। সংখ্যাগরিষ্ঠ বার্মিজরা চায় সেখানে বৌদ্ধদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হোক। সে মতবাদের আলোকে রোহিঙ্গারা ক্ষুদ্র ও ভিনদেশী বলে পরিচিত। দেশটির সাম্প্রতিক অগ্রযাত্রায়ও তাদের কোন স্থান নেই বলে বিশ্বাস করে নেপিডোর সরকার।

তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে মিয়ানমার বিদ্বেষী ও বৌদ্ধদের শত্রু হিসেবে। শুধু তাই নয়, জাতীয়তার প্রশ্নে তাদের গনায় ধরা হয় না। অর্থাৎ অভিন্ন পতাকার তলে মিয়ানমারের জাতীয়তার স্বীকৃতি পায়নি তারা। ফলে যাযাবরের জীবন কাটাতে হচ্ছে তাদের।
সাম্প্রতিক এক হিসাবে জানা যায়, প্রায় তিন লাখ শরণার্থী রোহিঙ্গা বাস করছে বাংলাদেশে। কিন্তু এরা কোনভাবেই বাংলাদেশী নাগরিক নয়, তা আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃত। ফলে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তাদের চলে যেতে জোর তাগিদ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু মিয়ানমার সীমান্তের কাঁটাতার ডিঙিয়ে তারা নিজ দেশে ফিরতে পারছে না। এ অবস্থায় রোহিঙ্গাদের পরিচয় এসে দাঁড়িয়েছে রাষ্ট্রহীন জাতিতে। তাছাড়া আরাকান অঞ্চলে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও তা রোধ করার জন্য কৌশল প্রণয়ন করেছে সরকার। ২৫ বছরের পূর্বে মুসলমানদের বিয়ে করার অনুমতি নেই। আর অনুমতি দিলেও রোহিঙ্গাদের জন্য বিয়ের আগে নিবন্ধন করার বাধ্যবাধকতা করা হয়েছে। ফলে নিজ দেশেই ফেরারি জীবনযাপন করে তারা। আর এ নির্মম অত্যাচার তাদের প্রতিশোধপরায়ণ করে তুলেছে। বহুদিনের জমানো ক্ষোভের বিস্ফোরণে জ্বলে উঠেছে রোহিঙ্গারা।

অন্যদিকে ১৭০০ শতকের সময় এশিয়ার বিখ্যাত বাণিজ্য নগরী বলে পরিচিত আরাকানের এমরায়ুক ইউ শহরের স্বাধীন সুলতান ছিলেন একজন মুসলমান। তাহলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, রোহিঙ্গা ও দেশটির অন্য আদিবাসী মুসলমানরা মিয়ানমারে ভুঁইফোড় অথবা উড়ে আসা অধিবাসী নয়। তাদেরও সমৃদ্ধ অতীত রয়েছে। এর বিপরীতে গত কয়েক দশক ধরে লাখ লাখ চীনা শরণার্থী আস্তানা গেড়েছে দেশটিতে। শুধু বৌদ্ধ হওয়ায় তাদের সাত খুন মাফ করেছে মিয়ানমার সরকার। ধর্মের সম্প্রীতি মিশে গেছে স্থানীয় জনগণের সঙ্গে। এর বিরুদ্ধে কখনও কোন বিদ্রোহ তৈরি হয়নি। কিন্তু নিজ দেশে পরবাসী জীবনযাপন করছে রোহিঙ্গা ও অন্য মুসলিম আদিবাসী গোষ্ঠীর মানুষ। বহির্বিশ্বে তাদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডকে শুধু প্রচার করা হয়, তাদের অধিকারের কথা কখনও ভুলেও বলা হয় না। রোহিঙ্গাদের অধিকার নিয়ে কথিত নোবেল জয়ী অং সান সুচিও আলাপ তুলেনা। সুতরাং রোহিঙ্গা মুসলমান আদিবাসীরা মিয়ানমারে এখন অবাঞ্ছিত। কিন্তু নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তারাও এখন মুসলিম চেতনায় বিশ্বাসী। ফলে সংঘাত অনিবার্য, তারই প্রমাণ মিলল সাম্প্রতিক দাঙ্গায়। (আল জাজিরা)

মিয়ানমারে হাজার হাজার ছাড়িয়ে লাখের দ্বারে মুসলিম শহীদ

২০ ট্রলার বোঝাই রোহিঙ্গা মুসলিম ৫ দিন যাবৎ সাগরে ভাসছে
০ সারাদিন প্রবল বর্ষণে উদ্বাস্তুরা কাকভেজা ভিজছে রোহিঙ্গা মুসলমানরা
০ রোহিঙ্গা মুসলিমদের ব্যাপারে নিশ্চুপ সুচি, নোবেল আনতে ইউরোপ গেলো
০ টেকনাফে রোহিঙ্গাদের খোঁজে বিজিবির তল্লাশি০
০ গ্রামের পর গ্রামে আগুন এখনও জ্বলছে


দাউ দাউ জ্বলে আরাকান ঘরে ঘরে কান্নার রোল
চলছে গণহত্যা-লুন্ঠন আর সম্ভ্রমহরণ
নাফ নদে নৌকার সারিতে রোহিঙ্গাদের হাহাকার
এপাড়-ওপাড় দুপাড়েই ঠাঁইহীন বুভুক্ষু মুসলিমের আর্তনাদ
অফুরন্ত অন্তর্দাহন বিজিবি কোস্টগার্ডের হৃদয়ের সীমানায়
তবুও নিরুপায় পুশব্যাক
সীমান্তে 'সীল মোহর'
মিয়ানমারের এ কোন বর্বরতা?

মিয়ানমারের আরাকানে গণহত্যা আর সীমান্তের নাফ নদীতে ভাসমান শরণার্থীর এমন আহাজারি সপ্তাহকালেও থামেনি।

মিয়ানমারের আরাকানে মুসলিম অধ্যুষিত গ্রামের পর গ্রামে আগুন জ্বলছে। গত কদিনে হাজার হাজার মুসলমান শহীদ হয়েছেন। ২০ ট্রলার বোঝাই দুই সহগ্রাধিক মুসলমান ৫ দিন যাবৎ সাগরে ভাসছে। সারাদিন প্রবল বর্ষণে কাকভেজা হয়ে ভিজে তারা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এদের মানবিক বিপর্যয়ে দুই দেশের কেউ এগিয়ে আসছে না। এদিকে আরাকানে রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর সংখ্যাগুরু বৌদ্ধদের হামলায় বিপর্যস্ত মুসলমানরা সে দেশের গণতন্ত্রপন্থী হিসেবে পরিচিত অং সান সুচির কাছে সাহায্যের আবেদন জানালেও সুচি এ পর্যন্ত কোন কথা বলেনি। তদুপরি দেশের এই সহিংস অবস্থায়ও সে নোবেল পুরস্কার আনতে ইউরোপ গেছে।

মিয়ানমারের আরাকানে আগুনের লেলিহানে জ্বলছে মুসলিম অধ্যুষিত গ্রামের পর গ্রাম। ক'দিনের হামলায় শুধু মংডুতেই শহীদ হয়েছেন শত শত মুসলমান। মিয়ানমারের নাসাকা বাহিনীর লুণ্ঠনসহ সামরিক সেনাদের হামলা-গুম, নির্যাতনের শিকার ২ সহগ্রাধিক মুসলমান ২০টি ট্রলারযোগে উভয় দেশের নৌ সীমান্তের কয়েকটি পয়েন্টে ৫ দিন যাবৎ ভাসমান অবস্থায় দিনাতিপাত করছে। এদের অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। উভয় দেশের কেউই এদের মানবিক সহায়তায় এগিয়ে আসছে না। চলতি মাসের শুরুতেই মিয়ানমারে ১০ জনসহ ১২ মুসলমানকে মগ সন্ত্রাসীরা হত্যা করার পর থেকে ওই দেশের মুসলিম প্রধান প্রায় নাসাকা-লুণ্ঠন ও সামরিক বাহিনীর হামলা তীব্রাকারে বৃদ্ধি পায়। এ থেকে এ পর্যন্ত হত্যা-গুম, নির্যাতন, সম্ভ্রমহরণ, অগ্নিসংযোগসহ দিন দিন লোমহর্ষক ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নির্যাতনের শিকার হচ্ছে আরাকানের সব পর্যায়ের মুসলমান।

সামরিক জান্তার সহায়তায় নাসাকার তীব্র নির্যাতন থেকে রেহাই পাচ্ছেন না নারী ও শিশুরা। আরাকানে হাজার হাজার বাড়িঘর আগুনে জ্বলছে। রচিং-এর সামরিক জান্তার কার্যালয় ৮ গ্রামের মগ ও মুসলমান সম্প্রদায়ের সরদার ও মাতবরকে শান্তি আলোচনার জন্য ডেকে নিয়ে মগনেতাদের ছেড়ে দিয়ে আটকিয়ে রাখে মুসলিম নেতাদের। ধারণা করা হচ্ছে এদের খুন ও গুম করা হয়েছে। এদের কয়েকশআত্মীয়-স্বজনদের মাঝে আহাজারী বৃদ্ধি পাচ্ছে। একই এলাকার জেলখানা থেকে কয়েদী দেখে স্ব স্ব বাড়ি ফেরার পথে মহিলারা ইসংসন নাসাকা প্রধানের হাতে সম্ভ্রমহরণের শিকার হয়।

এদিকে নির্যাতনের শিকার কয়েক হাজার মুসলিম নারী-পুরুষ ও শিশু বিগত ৫ দিন যাবৎ সাগরে ২০টি বোটে করে ভাসছে। গত বৃহস্পতিবার ভোর রাত থেকে ওই ক্ষুধার্ত মানুষগুলো মুষলধারে বৃষ্টিতে কাকভেজা ভিজেছে। এখানে অনেকেই ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে বলে জানান শাহপরীর দ্বীপের প্রত্যক্ষদর্শী ছাত্র মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ।

মিয়ানমারে সীমান্তবর্তী নাফ নদীর উপকূলের ছোট্ট শহর টেকনাফ থেকে বৃহস্পতিবার এএফপির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বুধবার বাংলাদেশের শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে বসবাসরত রোহিঙ্গারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তাদের ব্যাপারে কথা বলতে এবং সাহায্যের আবেদন জানতে সুচিকে আহবান জানায়।

এ বিষয়ে টেকনাফের নয়াপড়া শরণার্থী ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ ইসলাম বলেন, আমরা আমাদের অবস্থা সম্পর্কে জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, মিয়ানমার সরকার এবং বিশেষ করে সুচির দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। সুচি এখনো আমাদের জন্য কোন কিছু করেনি এবং কিছু বলেনি। অথচ ১৯৯০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গারা এমনকি আমার বাবা মা তার পক্ষে নির্বাচনী অভিযানে অংশ নিয়েছেন। তবু অন্য সব বার্মিজ বৌদ্ধদের মতো সেও রোহিঙ্গাদের অধিকার সম্পর্কে নিশ্চুপ রয়েছে।

ইসলাম আরো বলেন, সূচি মিয়ানমারের শরণার্থীদের বিষয়ে কথা বলতে গেলে খ্রিস্টান কারেনদের ব্যাপারেই কথা বলে। কিন্তু রোহিঙ্গা মুসলিমদের ব্যাপারে একটিও আশার বাণী শোনায় না। আমরা শুনেছি বর্তমানে মিয়ানমার সরকার ও সুচি দেশে রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য ম্যান্ডেট নিয়ে এসেছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি। বর্তমানে সহিংসতার সুযোগ রাখাইন বৌদ্ধ এবং নিরাপত্তা বাহিনী মুংডু শহরের ময়দাপাড়া গ্রামের সকল মসজিদ দখল করেছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি। এছাড়া সেখানে বহু রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে বলেও ইসলাম জানান। এই সব কর্মকান্ড নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে রাখাইনরা আরাকান দখলের মাস্টার প্ল্যানের অংশ হিসেবে করছে বলে মনে করেন তিনি।

টেকনাফের শাহ পরীর দ্বীপ দিয়ে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী মিয়ানমারের ২৫ নাগরিককে ফেরত পাঠিয়েছে বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়ন (বিজিবি)। মিয়ানমারে সহিংসতার কারণে রাখাইন প্রদেশ থেকে পালিয়ে এসে রোহিঙ্গারা টেকনাফের কোথাও অবস্থান নিয়েছে কি-না তা অনুসন্ধানে বিভিন্ন স্থানে তল্লাশিও চালানো হচ্ছে। বিজিবি ৪২ ব্যাটালিনের অপারেশন অফিসার ক্যাপ্টেন কামরুল হাসান বলেন, গত বুধবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে শাহ পরীর দ্বীপ জেটি ঘাট দিয়ে একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে ২৫ জন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ অবৈধ অনুপ্রবেশের চেষ্টা করে। বিজিবি সদস্যরা তাদের আটক করে বৃহস্পতিবার সকাল ৭টার দিকে পুশব্যাক' করে। ক্যাপ্টেন কামরুল হাসান, রোহিঙ্গারা যাতে টেকনাফের কোথাও আত্মীয়' পরিচয়ে অবস্থান করতে না পারে সে জন্য গত বুধবার রাতে মিস্ত্রীপাড়া ও জেলেপাড়ার বিভিন্ন ঘরে তল্লাশি চালানো হয়। তবে এ সময় কাউকে আটক করা হয়নি।

গত মঙ্গলবার রাত ও বুধবার সকালে টেকনাফের শাহ পরীর দ্বীপ, বদর মোকাম ও সেন্টমার্টিন এলাকা থেকে ১১৪ জন রোহিঙ্গাকে আটক করে মিয়ানমারে ফেরত পাঠায় বিজিবি। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিঅর এই রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে বাংলাদেশের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। তবে দুই দশক ধরে প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গা প্রবেশের পর তাদের নিয়ে সঙ্কটে থাকা বাংলাদেশ এই আহবান প্রত্যাখ্যান করেছে। নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে ঠেকাতে কাজ করছে বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বিজিবি স্থল সীমান্তে পাহারা জোরদারের পাশাপাশি নাফ নদীতেও স্পিডবোট নিয়ে টহল দিচ্ছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বারবার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার দাবি জানানো হলেও তাতে সাড়া দেয়নি মিয়ানমার। (একটি জাতীয় দৈনিক)

মানবিক বিপর্যয়ের মুখে রোহিঙ্গা মুসলিমরা :

নিজ দেশে গণহত্যার শিকার, বাংলাদেশে প্রবেশ নিষিদ্ধ

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে জাতিগত শুদ্ধি অভিযান অব্যাহত আছে। রাখাইন রাজ্যের মংডু ও আকিয়াব এলাকায় চলছে গণহত্যা ও বেপরোয়া লুটতরাজ। রোহিঙ্গাদের হাজার হাজার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। এ অবস্থায় মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন পৃথিবীর সবচেয়ে নিপীড়িত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় রোহিঙ্গারা।

চলমান সহিংসতায় কমপক্ষে হাজার হাজার মুসলমানকে শহীদ ও উদ্বাস্তু করা হয়েছে। এসব উদ্বাস্তু খাদ্য ও নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য মরিয়া হয়ে দিগিবিদিক ছুটে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু কোথাও নিরাপদ আশ্রয় মিলছে না রোহিঙ্গা মুসলমানদের।

গত বুধবার রাতেও বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন রাখাইন রাজ্যের দুটো গ্রামে ঘরে ঘরে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে রাখাইন বৌদ্ধরা। সাম্প্রদায়িক এই দাঙ্গায় অন্তত হাজার হাজার ঘরবাড়িও জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে।

বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইনদের সহায়তায় মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী নাসাকা, পুলিশ ও লুন্টিনবাহিনী এই হত্যাকান্ড ও লুটতরাজের ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছে। এদিকে নিজ দেশেই চরম নিপীড়নের শিকার রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশে প্রবেশের পথও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য পরিবার-পরিজন নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হচ্ছেন তারা। বুকফাটা কান্না আর মৃত্যুকে মেনে নিয়ে আবার মিয়ানমারে ফিরে যেতে হচ্ছে হতভাগ্য রোহিঙ্গাদের। অনেকে আবার জীবন বাঁচাতে নৌকায় করে নদীতে থাকার চেষ্টা করছেন। অনেকের লাশ ভাসছে বঙ্গোপসাগরে। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নিগৃহীত সংখ্যালঘু হচ্ছে রোহিঙ্গা মুসলিমরা।

এদিকে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট, জাতিসংঘ এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানালেও মিয়ানমারে গণহত্যা বন্ধে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নিচ্ছেনা।

জ্বলছে গ্রামের পর গ্রাম :

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এখনও চলছেই। রাখাইন রাজ্যের মংডু ও আকিয়াব এলাকায় চলছে গণহত্যা ও লুটতরাজ। জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। মিয়ানমারের স্থানীয় সূত্রগুলো বলেছে, রাখাইনের অধিবাসীদের সহায়তা দিয়ে নাসাকা, পুলিশ ও লুণ্ঠিনবাহিনী এই হত্যাকান্ড ও লুটতরাজের ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছে। আরাকান রাজ্যের মুসলমানরা মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন।

শুধু মংডুতেই হাজার হাজার মুসলমানকে শহীদ করেছে রাখাইন বৌদ্ধরা। নিখোঁজ রয়েছেন হাজার হাজার মুসলমান। রাখাইন-মুসলমানদের দাঙ্গায় মুহূর্তেই সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন হাজার হাজার ব্যবসায়ী ও মধ্যবিত্ত রোহিঙ্গা পরিবার। মিয়ানমার সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য জরুরি অবস্থা ও সান্ধ্যআইন জারি রাখলেও তা কেবল মুসলমানদের উপর কার্যকর করা হচ্ছে। রাখাইন বৌদ্ধরা অলিখিতভাবে সান্ধ্যআইনের বাইরে রয়েছে।

মংডু এলাকার দক্ষিণ, নয়াপাড়া, বমুপাড়া, মাঙ্গালাপাড়া, সম্মন্যাপাড়া, চারমাইল, হাদির বিল ও ঝুড়ারপাড়া এবং আকিয়াবের নাজিরপাড়া, মৌলভীপাড়া, মং লেংপাড়া, বাহারছড়া, ছাক্কিপাড়া, জালিয়াপাড়া, রোহাইঙ্গা ও ওয়ালিদপাড়া সম্পূর্ণ জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। আবু বকর জানান, এসব এলাকায় কয়েকদিন আগেও যারা সচ্ছল জীবনযাপন করতেন মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে এখন তারা সম্পূর্ণ নিঃস্ব হয়ে গেছেন।

মংডু ও আকিয়াবে কোনো মুসলমান যুবতি ঘরে থাকতে পারছে না। রাখাইন যুবকরা লুণ্ঠিন বাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় মুসলমান যুবতীদের ঘর থেকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। কয়েকদিনে এরকম ৫ হাজারের অধিক মুসলমান তরুণী নিখোঁজ হয়ে গেছেন। তাদের আদৌ ফিরে পাওয়া যাবে না বলেই বিশ্বাস করছেন মিয়ানমারের ওইসব এলাকার বাসিন্দারা।

যেসব বাংলাদেশী ব্যবসায়ী দাঙ্গার কারণে মিয়ানমারে আটকা পড়েছিলেন তাদের মধ্যে মঙ্গলবারও ৫ জন ফিরে এসেছেন। এখনও ৮ জন মিয়ানমারেই অবস্থান করছেন। অন্যদিকে মঙ্গলবার ১২ জন মিয়ানমার নাগরিক টেকনাফ ট্রানজিট পয়েন্ট হয়ে তাদের দেশে ফিরে গেছেন। তবে এখানে ৫৯ জন মিয়ানমার নাগরিক বাংলাদেশে অবস্থান করছেন।

কালাদান প্রেস জানিয়েছে, মংডুতে পুলিশের একজন উগ্রপন্থী পুলিশ কর্মকর্তার উস্কানিতে রাখাইন, দাঙ্গা পুলিশ ও পুলিশ মুসলমানদের বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। থাননামের ওই পুলিশ কর্মকর্তা নিজেই আগুন দেয়ার কাজে জড়িত। এতে বলা হয়, ১৪৪ ধারা মংডুতে কেবল রোহিঙ্গাদের উপর প্রযোজ্য কিন্তু রাখাইনরা এটি মান্য করছে না এবং তারা সব জায়গায় চলাফেরা করছে। রাখাইনরা পুলিশের সাহায্যে রোহিঙ্গাদের ঘর থেকে খাদ্যশস্য ও জিনিসপত্র লুণ্ঠন করছে। রোহিঙ্গা মুসলমানরা এখন গুরুতর খাদ্য সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।

রোহিঙ্গাদের ঢুকতে দেয় নি বিজিবি :

মিয়ানমারের রাখাইন ও সরকারি বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ ও লুটতরাজ থেকে বাঁচতে শত শত রোহিঙ্গা মুসলমান বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে বাংলাদেশ সীমান্তে বিজিবি কঠোর অবস্থান নিয়েছে। তারা কোনো রোহিঙ্গাকেই বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে দিচ্ছে না। যারাই আসছে তাদেরকেই পুশব্যাককরা হচ্ছে।

অপরদিকে নাফ নদীর মোহনা ঘোলারচর এলাকায় ৫০ জনেরও বেশি রোহিঙ্গাভর্তি একটি ইঞ্জিন বোট চরে আটকা পড়েছিল। সাগরে প্রচন্ড ঝড় এবং উত্তাল থাকায় রোহিঙ্গাভর্তি ওই ট্রলারটি কোথাও যেতে পারছিল না।

অপরদিকে গত ১৩ জুন বুধবার টেকনাফ শাহপরীর দ্বীপ ও সেন্টমার্টিনে প্রবেশের চেষ্টাকালে বিজিবি ও কোস্টগার্ড রোহিঙ্গা বোঝাই ৩টি ট্রলার গভীর সাগরের দিকে চলে যেতে বাধ্য করে। সকালে সেন্টমার্টিন দ্বীপের দক্ষিণ উপকূল দিয়ে ৩৯ জন রোহিঙ্গা নিয়ে একটি ট্রলার কূলে ভিড়তে চাইলে কোস্টগার্ডের টহলদল তাদের আটক করে। একই দিন সকালে শাহপরীর দ্বীপের অদূরে নাফ নদীর ঘোলারচর মোহনা দিয়ে ৪৪ জন রোহিঙ্গা নিয়ে একটি এবং ৩০ জন রোহিঙ্গা নিয়ে আরও একটি ট্রলার কূলে ভিড়তে চেষ্টা করে। বিজিবি ও কোস্টগার্ড ৩টি ট্রলার আটক করে। এ সময় ট্রলারে থাকা রোহিঙ্গাদের অনেকেই অভুক্ত এবং আহত ছিল। স্থানীয়দের সহয়তায় এসব রোহিঙ্গার কিছু শুকনো খাবার, খাবার স্যালাইন ও পানি দিয়ে ৩টি ট্রলারকেই গভীর সাগরের দিকে চলে যেতে বাধ্য করে বিজিবি ও কোস্টগার্ড। এ সময় সাগরে প্রচন্ড বৃষ্টিপাত হচ্ছিল। ৩টি ট্রলারের অধিকাংশই নারী ও শিশু এবং তারা আরাকান প্রদেশের রাজধানী আকিয়াব শহরতলীর বিভিন্ন পাড়া থেকে আশ্রয় নেয়ার জন্য এসেছে বলে তারা জানিয়েছিল। (একটি জাতীয় দৈনিক)

বিপন্ন আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলমান

মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশে রাখাইন-মুসলিম ভয়াবহ দাঙ্গার রেশ এখনও কেটে উঠছে না। রাখাইন বৌদ্ধদের দেয়া আগুনের লেলিহানে দাউ দাউ করে জ্বলছে মুসলমানদের বাড়িঘর, মসজিদসহ বিভিন্ন স্থাপনা। দিন দিন নিহতের সংখ্যা বেড়েই চলছে। মিয়ানমারের রাখাইন বৌদ্ধদের নির্যাতন, নাসাকা বাহিনী ও সামরিক জান্তার অমানবিক জুলুমের শিকার রোহিঙ্গা মুসলিমরা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে আর্তনাদ ও আহাজারির পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছে। ভুক্তভোগী মুসলমানদের জীবন কাটছে মানবেতর।
রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সর্বোচ্চ নজরদারিতে রয়েছে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি)। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশঙ্কায় সেন্টমার্টিন থেকে উখিয়ার মনখালীর ঘাট পর্যন্ত সব ধরনের নৌযান চলাচলের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। অনুপ্রবেশ ঠেকাতে অস্থায়ী ক্যাম্পও স্থাপন করা হয়েছে। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশঙ্কায় উখিয়ার মনখালীতে অস্থায়ী যৌথ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। মনখালী থেকে সেন্টমার্টিন পর্যন্ত নৌযান চলাচল সীমিত করা হয়েছে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড ওই এলাকায় টহল দিচ্ছে।
বর্তমান সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় এনে এ কথা অনেকেই বলেছেন যে, রোহিঙ্গা সমস্যা দিন দিন আরও জটিল হচ্ছে। এ অবস্থায় সকল মহলের এখন প্রশ্ন বাংলাদেশে বিরাজিত রোহিঙ্গা সমস্যার আদৌ কি কোন সমাধান হবে কি? বাংলাদেশের ভূখন্ডে রোহিঙ্গা সমস্যার রয়েছে এক সুদীর্ঘ ইতিহাস।
বর্তমানে মিয়ানমারের অন্তর্গত আরাকান প্রদেশ ছিল একটি সুপ্রাচীন আলাদা দেশ। মোঘল, তিববত, ভ্রহ্ম ও বহু উপজাতি নিয়ে প্রাচীন আরাকানের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী নিয়ে গঠিত। ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে ব্রহ্মরাজ বোধপায়া স্বাধীন আরাকান রাজ্যে দখল করে ব্রহ্মদেশের অন্তর্ভুক্ত করে। সে থেকে মূলত এ ভূখন্ডে রোহিঙ্গা সমস্যা বর্মী সৈন্যরা আরাকানের গ্রাম গ্রামান্তরে মুসলমানদের একত্রিত করে যত সম্ভব হত্যা করে। বর্মী সেনাদের অত্যাচার নির্যাতন সম্পর্কে তৎকালীন আরাকানী সর্দার অ্যাপোল-এর জবানীতে জানা যায়, বর্মী সেনারা নির্বিচারে ২ লাখ আরাকানীকে হত্যা করে এবং সমসংখ্যক দাস হিসেবে বার্মায় প্রেরণ করে। বর্মী রাজ্যের এ ধরনের নির্যাতন, খুন, হত্যা-নিপীড়নের ফলে আরাকান রাজ্যের সন্নিকটস্থ কক্সবাজারে আশ্রয় গ্রহণ করে।
এ বিষয়ে হেয়াল্টার হেমিল্টন লিখেছে যে, সে ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে রামুর শরণার্থী শিবিরে লক্ষাধিক আরাকানী শরণার্থীর অবস্থান দেখেছে।
সংশ্লিষ্ট মহল উল্লেখিত ঘটনা প্রবাহ বিশ্লেষণ করে জানায় এ ঘটনার মধ্যে দিয়ে মূলত আরাকান অঞ্চলে বসবাসরত মুসলিম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সাথে বর্মীদের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। একই রাষ্ট্রের নাগরিক হলেও রোহিঙ্গা মুসলিম ও বৌদ্ধ বর্মীদের মাঝে ২শ' বছরেরও বেশি সময় আগে থেকে শুরু হওয়া দ্বন্দ্ব সংঘাতের ধারাবাহিকতা আজকে পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। এ ধারাবাহিকতায় তাদের মধ্যে টানাপোড়েন অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছলে বা সীমা ছাড়িয়ে গেলে আরাকানে বসবাসরত রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠী নিরাপদ আশ্রয় অর্থাৎ কক্সবাজারের টেকনাফ চলে আসে। এভাবে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনা একদিনের জন্যও সম্ভবত থেমে নেই।
গত সোয়া ২শবছরের ইতিহাসে ব্যাপকহারে অর্থাৎ এক সাথে ৩ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে চলে আসে।
পরবর্তী ১৯৭৯ সালে মিয়ানমারের ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি মোতাবেক ওই সময় ৩ লাখ রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত নিয়ে যায়, ১৯৭৮ সালে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের পর এক যুগের ব্যবধানে আবারো ১৯৯১ সালের নভেম্বর মাসে পুনরায় বাংলাদেশে ২ লাখ ৬৫ হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এ শরণার্থীদের নিয়ে শুরুতেই ঘটে শুভংকরের ফাঁকির একটি ঘটনা। এ সময় টেকনাফের অভ্যর্থনা পয়েন্টে বাংলাদেশ ২ লাখ ৬৫ হাজার শরণার্থীকে গ্রহণ করলেও তাদের ২০টি শরণার্থী শিবিরে রেখে সেখানে গণনার সময় মোট শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ২ লাখ ৫০ হাজার ৮৭৭ জন। এ হিসাবের শুরুতেই প্রায় ১৫ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পালিয়ে যায় কৌশলে। বর্তমানে ২ লাখ ৫০ হাজার ৮৭৭ জন শরণার্থীর মধ্যে ২০ হাজার ৩৬৭ জন শরণার্থী প্রত্যাবাসনের অপেক্ষায় কুতুপালং এবং নয়াপাড়া শিবিরে অবস্থান করছে।
রোহিঙ্গা শরণার্থীরা চাচ্ছে তাদের সমস্যাটি দ্রুত সমাধান হোক। টেকনাফ নয়াপাড়ার শরণার্থী ক্যাম্পের রোহিঙ্গা যুবক আনছারুল্লাহ (২৫) জানান, তারা এখনো উদ্বাস্তু, বর্তমানে তারা রাষ্ট্রহীন নাগরিক। তাদের নাগরিকত্ব নেই মিয়ানমারে, নেই বাংলাদেশেও। তারা দাবি তুলছে তাদের স্বদেশে (মিয়ানমারে) ফিরিয়ে নেয়া হোক। অন্যথায় শিবির থেকে মুক্তি দিয়ে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হোক। এটিও সম্ভব না হলে তাদেরকে তৃতীয় কোন রাষ্ট্র পুনর্বাসিত করা হোক। আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে তারা লিখিতভাবে এ দাবি জানিয়েছেন। তবে তাদের দাবি সম্পর্কে বাংলাদেশের অবস্থান সুস্পষ্ট।
বাংলাদেশ সাফ জানিয়ে দিয়েছে রোহিঙ্গাদেরকে কোন মুহূর্তে নাগরিকত্ব প্রদান করবে না। তবে তাদেরকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ অদ্ভুত সার্বিক পরিস্থিতিতে সত্যি রোহিঙ্গা সমাধানটি দিন দিন প্রকট হচ্ছে। সমস্যার জট অতি সহজে খুলবে এমনটি আশা করার কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না এ মুহূর্তে। গত ১ সপ্তাহ ধরে মিয়ানমারে আরাকান রাজ্যের মুসলিম রোহিঙ্গারা দেশটির নাসাকা, রাখাইন যুবক, লুণ্ঠন বাহিনীর ত্রি-মুখী বর্বরোচিত হামলার শিকার হয়ে প্রায় ১০ হাজার মুসলিম রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছে বলে জানা গেছে।
গত ১ সপ্তাহ ধরে মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ কালে প্রায় ১৫শনারী-পুরুষ শিশুকে বিজিবি ও কোস্টগার্ড মিলে পুশব্যাক করা হয়।
এ দিকে আরাকানে সৃষ্ট দাঙ্গার প্রেক্ষিতে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতে জাতিসংঘ বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ করলেও মিয়ানমারকে গণহত্যা বন্ধ করতে বলছে না। অপরদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছে কোন রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে আর ঢুকতে দেয়া হবে না। তাই জাতিসংঘসহ ওআইসির উচিত মিয়ানমারের নাগরিক নির্যাতিত রোহিঙ্গা মুসলমানদের গণহত্যা বন্ধ করা এবং যাতে তাদের বসতভিটে ফিরে পায় এবং নিরাপদে তাদের দেশে বসবাস করতে পারে সে ক্ষেত্রে মিয়ানমারের সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করা।

সূত্রঃ
১) হুমায়রা নামক ব্লগার
২) http://al-ihsan.net





[বিঃদ্রঃ তথ্য প্রদানে ভাষাগত কোন ভুল থাকলে দয়া করে মেইল করে জানাবেন। নির্যাতনের ঘটনাসমূহ সংগ্রহে থাকলে দয়া করে রেফারেন্সসহ মেইল করবেন।]


[ট্যাগঃ পীর-মুরীদি (মুরিদি) ব্যবসাধারী ভন্ড-পীর সহ ধর্মব্যবসায়ীদের জম রাজারবাগ দরবার শরীফ, রাজারবাগী পীর সাহেব কিবলা আলাইহিস সালাম]