আল্লাহ পাক অন্যত্র ইরশাদ করেন, তিনি (আল্লাহ পাক) ইনসানকে সৃষ্টি করেছেন এবং বয়ান শিক্ষা দিয়েছেন।” (সূরা আর রহ্মান/২, ৩)
এখানে ‘বয়ান’ এর তাফসীরে উল্লেখ করা হয়েছে, যা সৃষ্টি হয়েছে এবং হবে। অর্থাৎ পূর্ব ও পরবর্তী সব ঘটনার জ্ঞান। (তাফসীরে মা’আলিমুত তানযীল)
অর্থাৎ আয়াত শরীফ-এর অর্থ হচ্ছে- আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহ পাক সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁকে সমস্ত কিছুর জ্ঞান দান করেছেন।
যেমন, আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আমাকে সৃষ্টির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সমস্ত জ্ঞান দান করা হয়েছে।
হাদীছ শরীফে আরো ইরশাদ হয়েছে, ছাহিবে ছলাত ও সালাম, আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আমাকে (শুরু হতে শেষ পর্যন্ত) সমস্ত ইল্ম প্রদান করা হয়েছে। (বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ)
অতএব, প্রমাণিত হলো যে, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সৃষ্টির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সমস্ত ইল্মের অধিকারী। আর লিখাও হচ্ছে ইল্মের একটা অংশ। লিখা যে ইল্মের অংশ তা সূরা ‘আলাক্ব’-এর ৪ নম্বর আয়াত-এর ‘আল্লামা বিল ক্বলাম’ ‘তিনি (আল্লাহ পাক) তাঁেক কলম দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন’, এ আয়াত শরীফ দ্বারা স্পষ্ট প্রমাণিত হয়। কারণ ‘আল্লামা’ শব্দটির মাছদার বা ক্রিয়ামূল হচ্ছে ‘তা’লীম’ বা শিক্ষা দেয়া। অতএব, স্বয়ং আল্লাহ পাক যাকে লিখার উপকরণ তথা কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন তিনি লিখতে জানতেন না বা লিখতে পারতেন না এ ধারণা পোষণ করা মিথ্যা তোহমত ও কুফরীর নামান্তর।
যামানার ইমাম ও মুজতাহিদ, মুজাদ্দিদে আ’যম, ইমামুল আইম্মাহ, কুতুবুল আলম, আওলাদে রসূল, সুলতানুল নাছির, সাইয়্যিদুনা ইমাম রাজারবাগ শরীফ-এর মামদূহ হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী তিনি বলেন, আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অবশ্যই লিখতে জানতেন।
তিনি বলেন, সাধারণের মাঝে একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে, আল্লাহর রসূল সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লিখতে জানতেন না। এমনকি অনেক তথাকথিত আলিমরাও এ কথা তাদের ওয়াজে জোরে-সোরে প্রচার করে থাকে। অথচ এটি সর্বৈব মিথ্যা, অজ্ঞতা প্রসূত ও কুফরীমূলক বক্তব্য।
তাফসীরে রূহুল বয়ানের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, “আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লিখা জানতেন এবং অক্ষর লিখার পদ্ধতি বলে দিতেন।”
মূলতঃ আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অবশ্যই লিখতে জানতেন। এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফ উল্লেখ করা হয়েছে, হযরত মুয়াবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সামনে (ওহী) লিখতেন, অতঃপর হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে অক্ষর লিখার পদ্ধতি শিক্ষা দিয়ে ইরশাদ করেন, দোয়াত এভাবে রাখ, কলম এভাবে ঘুরাও, ‘বা’কে এভাবে সোজা করে লিখ, ‘সীন’কে পৃথক কর, আর ‘মীম’কে বাঁকা করোনা, অথচ তিনি দুনিয়াবী কোন কাতিবের (লিখকের)-এর নিকট থেকে লিখা শিখেননি, আর কোন প্রাচীনকালীন কিতাব থেকেও তা পড়েননি।” (সুবহানাল্লাহি বিহামদিহী)
উল্লেখ্য, রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর লিখার প্রয়োজন হতো না। কারণ মানুষ লিখে থাকে এজন্য যে, লিখে না রাখলে ভুলে যাবে। কিন্তু রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর লিখার প্রয়োজন নেই। কারণ তিনি সমস্ত কিছুই জানতেন এবং উনাকে সমস্ত ইল্ম দেয়া হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে তিনি আল্লাহ পাক-এর কায়িম-মুক্বাম অর্থাৎ আল্লাহ পাক-এর যেমন লিখার প্রয়োজন নেই। তেমনি হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এরও প্রয়োজন নেই। আর তাঁর মুয়াল্লিম স্বয়ং আল্লাহ পাক। সুতরাং তাঁর লিখা-পড়ার কোন প্রয়োজন ছিল না। আর তিনি যদি লিখা-পড়া করতেন তাহলে বাতিলপন্থীরা সন্দেহ করতো।
যেমন, পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবে আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আবির্ভাবের পরিচয় দেয়া ছিল কয়েকটি। যেমন, তিনি হবেন ‘উম্মী’ (অর্থাৎ নবীগণের মূল হবেন) এবং সুন্দর হস্তাক্ষরে লিখবেন কিন্তু পার্থিব ওস্তাদের কাছে লিখা-পড়া করবেন না। কোন বই-পুস্তক পড়বেন না।
যেমন, এ সম্পর্কে কুরআন শরীফে ইরশাদ হচ্ছে, “এর পূর্বে (নুবুওওয়াত প্রকাশের পূর্বে) হে হাবীব (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপনি না কোন কিতাব পড়তেন এবং না নিজ হাতে কোন কিছু লিখতেন, যদি তা করতেন, তবে বাতিলপন্থীরা নিশ্চয়ই সন্দেহ করতো (যে এটা আল্লাহ পাক-এর বাণী নয়, আপনার রচিত কোন কিতাব)।” (সূরা আনকাবুত/৪৮)
আর তিনি যে লিখতে জানতেন এ প্রসঙ্গে “ছহীহ বুখারী শরীফ”-এর ‘কিতাবুল ইল্ম’-এর ‘বাবু কিতাবাতিল ইল্মে’ অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, “হযরত আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, যখন রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অসুস্থতা বৃদ্ধি পেল। তখন তিনি উপস্থিত ছাহাবীদের বললেন, তোমরা এক টুকরা কাগজ নিয়ে এস। আমি তোমাদের জন্য কতিপয় উপদেশ লিখে দিব, যাতে তোমরা পরবর্তী কালে পথভ্রষ্ট হবে না।
হযরত বারা ইবনে আযিব রদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, “নবীয়ে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যিলক্বদ মাসে ওমরাহ্ করতে গিয়েছিলেন, কিন্তু মক্কাবাসী তাঁকে মক্কা শরীফে প্রবেশ করতে দিতে রাজী ছিলনা, যতক্ষণ না তিনি তাদের সাথে এ মর্মে সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হন যে, তিনি সেখানে (মক্কা শরীফে) তিনদিনের অধিক অবস্থান করবেন না। অতঃপর যখন সন্ধিপত্র লিখার উপর ঐক্যমত হলো, তারা লিখলো ‘এতদ্বারা আল্লাহ পাক-এর হাবীব্ রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের সাথে সন্ধি করলেন।’ অতঃপর মক্কার কাফিররা বললো, আমরা এটা মানিনা, কারণ যদি আমরা আপনাকে আল্লাহ্র রসূল হিসেবে মেনে নিয়ে থাকি তাহলে আমরা আপনাকে তো কোন রকম বাঁধাও দিতাম না বরং আপনি হলেন, আল্লাহ পাক-এর হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ”ইবনে আব্দুল্লাহ্ আলাইহিস সালাম। সুতরাং এটাই লিখতে হবে।” তখন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমি আল্লাহ পাক-এর রসূল এবং আমিই হযরত আব্দুল্লাহ আলাইহিস সালাম-এর পুত্র, তারপর তিনি হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে বললেন, “রসুলুল্লাহ” শব্দটা কেটে দিন।”
হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু আনহু আরজ করলেন, না, আল্লাহ পাক-এর কসম! আমার পক্ষে (আল্লাহ্ পাক প্রদত্ত্ব) আপনার (গুণবাচক) নাম কাটা সম্ভব নয়। অতঃপর হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উক্ত চুক্তিপত্র খানা হাতে নিলেন। তাঁর নিজ হাতে লিখার ইচ্ছা ছিলনা, তবুও সুন্দরভাবে লিখলেন, “এতদ্বারা চুক্তি করলেন মুহম্মদ ”ইবনে আব্দুল্লাহ্ আলাইহিস সালাম (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)।”