সকল স্থানেই “গান-বাজনা” করা হারাম ও কবীরা গুণাহের অন্তর্ভূক্ত। তা যে কোন গানই হোক না কেন। যেমন নবী তত্ত্ব, মুর্শীদি, জারী, কাওয়ালী, পল্লীগীতি, ভাওয়ালী, ভক্তিমূলক ইত্যাদি যে কোন প্রকার গানেই হোক না কেন। তবে বাজনা বা বাদ্য-যন্ত্র ব্যতীত হামদ, না’ত, ক্বাছীদা, গজল ইত্যাদি পাঠ করা ও শোনা জায়েয রয়েছে।
তাই কিতাবে উল্লেখ আছে, ইলম দু’প্রকার।
(১) “ইলমে আরুজী” অর্থাৎ ছন্দ প্রকরন যেমন- “বালাগাল উলা বিকামালিহী ......... ও মীলাদ শরীফে পাঠকৃত ক্বাছীদাসমূহ, যা গানের সূরে পাঠ করা হয় না।
(২) “ইলমে মুসীক্বী” অর্থাৎ রাগ-রাগীনী বা গানের সূর। কাজেই বাদ্য-যন্ত্র বা বাজনাতো শরীয়তে সম্পূর্ণই নাজায়েয। সাথে সাথে বাদ্যবিহীন ইল্মে মুসীক্বীও নাজায়েয।মূলতঃ “গান-বাজনা” কুরআন শরীফ, হাদীস শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াসের অকাট্য ও কেৎয়ী দলীল দ্বারা সুস্পষ্টভাবে হারাম সাব্যস্ত হয়েছে।
মহান আল্লাহ্ পাক পবিত্র কালামে পাকের অসংখ্য স্থানে “গান-বাজনা” নিষেধ করেছেন। যেমন “সূরা লোকমানের” ৬নং আয়াত শরীফে এরশাদ ফরমান, অর্থঃ- “মানুষের মধ্যে কিছু লোক রয়েছে। যারা “লাহ্ওয়াল হাদীস” খরীদ করে থাকে। যেন বিনা ইল্মে মানুষদেরকে আল্লাহ্ পাক-এর পথ থেকে বিভ্রান্ত করে এবং হাসি-ঠাট্টারূপে ব্যবহার করে, তাদের জন্যে অপমানজনক শাস্তি রয়েছে।”
অনুস্মরণীয় মুফাস্সিরীন-ই-কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিগণ এ আয়াত শরীফে বর্ণিত “লাহ্ওয়াল হাদীস” দ্বারা “গান-বাজনাকে” সাব্যস্ত করেছেন। যেমন বিখ্যাত মুফাস্সির আল্লামা ইবনে কাছীর রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর “তাফসীরে ইবনে কাছীরের” ৮ম খন্ড, ৩-৪ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন, অর্থঃ- “বিশিষ্ট সাহাবী হযরত ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু “লাহ্ওয়াল হাদীস” -এর ব্যখ্যায় বলেন, “আল্লাহ্ পাক-এর কসম! “লাহ্ওয়াল হাদীস” হচ্ছে- “গান-বাজনা” বা সঙ্গিত।” ...... হযরত ইবনে আব্বাস, হযরত জাবের, হযরত ইকরামাহ, হযরত সাঈদ বিন জুবাইর, হযরত মুজাহিদ, হযরত মাকহুল, হযরত আমর ইবনে শোয়াইব ও হযরত আলী ইবনে বোযায়মা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এ ব্যাখ্যাই করেছেন।
আর বিশিষ্ট তাবেয়ী হযরত হাসান বসরী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, উক্ত আয়াত শরীফ গান ও বাদ্যযন্ত্র সম্পর্কে নাযিল হয়েছে।” এছাড়াও তাফসীরে কুরতুবী, তাবারী, দুররে মানছুর, রুহুল মায়ানী, মাদারেক, কাশ্শাফ, মায়ালিম, ছায়লবী ও ইমাম বোখারী রহমতুল্লাহি আলাইহি তার “আদাবুল মুফরাদ” কিতাবে “লাহ্ওয়াল হাদীস” অর্থঃ- “গান-বাজনা”,“বাদ্য-যন্ত্র” বলে উল্লেখ করেছেন।
অনুরূপ সূরা নজম ও বণী ইস্রাঈলেও “গান-বাজনা” হারাম হওয়ার ব্যাপারে আয়াত শরীফ রয়েছে। অতএব, কুরআন শরীফ-এর আয়াত শরীফ যা কিৎয়ী দলীল, তাদ্বারা সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হয়েছে যে, “গান-বাজনা”, “বাদ্য-যন্ত্র” ইত্যাদি সম্পূর্ণই হারাম ও আযাবের কারণ। “গান-বাজনা” ও “বাদ্য-যন্ত্র” সম্পর্কে অসংখ্য হাদীস শরীফও বর্ণিত রয়েছে, যেমন সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খতামুন্নাবিয়্যীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, “গান শোনা গুণাহের কাজ, গানের মজলিসে বসা ফাসেকী এবং গানের সাধ গ্রহণ করা কূফরী।”
অন্য হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, “পানি যেরূপ জমীনে খাস উৎপন্ন করে “গান-বাজনা” তদ্রুপ অন্তরে মুনাফেকী পয়দা করে।” (বায়হাক্বী ফী শুয়াবিল ঈমান)।
আখেরী রাসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খতামুন্নাবিয়্যীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো এরশাদ করেন, “আমি “বাদ্য-যন্ত্র” ও “মুর্তি” ধ্বংস করার জন্যে প্রেরীত হয়েছি।”
কুরআন শরীফ ও হাদীস শরীফের আলোকে ইমাম-মুজাতাহিদ তথা ফুক্বাহা-ই-কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহি গণ ফতওয়া দেন যে, “গান-বাজনা” বা “বাদ্য-যন্ত্র” সম্পূর্ণই হারাম। এটাকে হালাল বলা কূফরী।
যেমন আল্লামা শাহ্ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দেস দেহলবী রহমতুল্লাহি আলাইহি “তাফসীরে আযীযী”-এর ১ম খন্ডের ৬৫ পৃষ্ঠায় লিখেন,
অর্থঃ- “মুগনী” কিতাবে উল্লেখ আছে, “লাহ্ওয়াল হাদীস” হচ্ছে- “গান-বাজনা”, সঙ্গিত। এ আয়াত শরীফ দ্বারা তা হারাম সাব্যস্ত হয়েছে। যে ব্যক্তি এটাকে হালাল জানবে সে কাফের হবে।” “জামিউল ফতওয়াতে” উল্লেখ আছে, “গান-বাজনা” শ্রবন করা, “গান-বাজনার” মজলিশে বসা, “বাদ্য-যন্ত্র” বাজানো, “নর্ত্তন-কুর্দ্দন” করা সবই হারাম, যে ব্যক্তি এগুলোকে হালাল মনে করবে সে ব্যক্তি কাফের।” অনুরূপ প্রায় সকল ফিক্বাহের কিতাবেই “গান-বাজনা”, “বাদ্য-যন্ত্র” ইত্যাদিকে হারাম ফতওয়া দেয়া হয়েছে। সুতরাং কুরআন শরীফ, হাদীস শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াসের দলীল দ্বারা অকাট্যভাবেই প্রমাণিত হলো যে, “গান-বাজনা”, “বাদ্য-যন্ত্র” ইত্যাদি সব হারাম ও নাজায়েয। এগুলোকে হালাল মনে করা কূফরী। কাজেই কোন অবস্থাতেই “গান-বাজনা” করার অনুমতি শরীয়তে নেই তা যে কোন প্রকার গানই হোক না কেন।
দ্বিতীয়তঃ বলতে হয় যে, যারা বলে সুলতানুল হিন্দ, গরীবে নেওয়াজ, খাজা মুঈনুদ্দীন চিশ্তী রহমতুল্লাহি আলাইহি “গান-বাজনা” করেছেন। তারা তাঁর উপর চরম মিথ্যা তোহ্মত দেয়। কারণ তিনি ছিলেন মহান আল্লাহ্ পাক-এর খাছ ওলী তথা “হাবীবুল্লাহ্”। যিনি সারা জীবন সুন্নতের পুরিপূর্ণ অনুসরন-অনুকরন করেছেন। তাঁর পক্ষে কি করে হারাম “গান-বাজনা” করা সম্ভব? বিদ্য়াতীরা এ ব্যাপারে একটি দলীলও পেশ করতে পারবে না। তবে হ্যাঁ সুলতানুল হিন্দ, গরীবে নেওয়াজ, হাবীবুল্লাহ্ রহমতুল্লাহি আলাইহি “সামা” পাঠ করেছেন। আর বিদ্য়াতী, ভন্ড ফক্বীরেরা এটাকেই প্রচার করছে “গান-বাজনা” বলে। অথচ “গান-বাজনার” সাথে “সামার” বিন্দুমাত্রও সম্পর্ক নেই।
এ প্রসঙ্গে “ফাওয়ায়েদুল ফুওয়াদ” নামক কিতাবে উল্লেখ আছে যে, একদা দিল্লীর ৫০০ আলেমের সাথে হযরত নিজামুদ্দীন আউলিয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার বাহাস হয়। কারণ দিল্লীর সেই আলেমরা অপবাদ দিয়েছিল যে, হযরত নিজামুদ্দীন আউলিয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি “গান-বাজনা” করেন। বাহাসে যখন এ প্রশ্ন উত্থাপন করা হলো- তখন হযরত নিজামুদ্দীন আউলিয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, আমি কস্মিনকালেও “গান-বাজনা” করিনা বরং আমি “সামা” করি। আর আমার “সামা” পাঠের শর্ত হচ্ছে-
(১) সেখানে কোন “বাদ্য-যন্ত্র” থাকবে না, (২) কোন বেগানা মহিলা থাকবে না, (৩) কোন নাবালেগ দাড়ীবিহীন বালক থাকবে না, (৪) যে ছন্দগুলো পাঠ করা হবে তা শরীয়ত সম্মত হতে হবে। (৫) তা আল্লাহ্ পাক ও সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খতামুন্নাবিয়্যীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দিকে আকৃষ্টকারী হতে হবে, (৬) আর যাঁরা শুনবে, তাঁরা সবাই বুযুর্গ পরহেজগার ও আল্লাহ্ওয়ালা হতে হবে। যখন হযরত নিজামুদ্দীন আউলিয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি একথা বললেন, তখন দিল্লীর আলেমরা তাকে হক্ব বলে মেনে নিলেন এবং নিজ ভুলের জন্য লজ্জিত হলেন। কাজেই পূর্ববর্তী আউলিয়া-ই-কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহি গণ যে “সামা” পাঠ করেছেন তা এরূপই ছিল। সেই “সামার” সাথে বর্তমান জারী বা কাওয়ালীকে তুলনা করা কূফরী বৈ কিছুই নয়। অতএব, প্রমাণিত হলো- সুলতানুল হিন্দ, গরীবে নেওয়াজ, খাজা মুঈনুদ্দীন চীশ্তি রহমতুল্লাহি আলাইহি জীবনে কখনোই “গান-বাজনা” করেননি। যারা ওনার নামে মিথ্যা তোহমত দেয় তারা চরম ফাসেক ও কবীরা গুণাহে গুণাহ্গার। তৃতীয়তঃ বলতে হয় যে, যারা বলে বোখারী শরীফে “গান-বাজনা” জায়েয লেখা আছে তারা চরম জাহেল ও বেদ্য়াতী। আর জাহেল বলেই বোখারী শরীফের ৫ম খন্ড দলীল হিসেবে পেশ করেছে। অথচ মুল বোখারী শরীফের কোন ৫ম খন্ডই নেই। সে ব্যক্তিকে শুধু এতটুকু বলবেন যে, “বোখারী শরীফের যেখানে “গান-বাজনা” জায়েয বলা হয়ছে সে অংশটুকু বাংলায় অনুবাদ করে দাও।” তবেই তার মিথ্যা দলীলের হাক্বীক্বত প্রকাশ পেয়ে যাবে।
মূলতঃ বোখারী শরীফের কোথাও যদি “গান-বাজনা” জায়েয লেখা থাকতো তবে ইমাম বোখারী রহমতুল্লাহি আলাইহি তার “আদাবুল মুফরাদ” কিতাবে “গান-বাজনা” হারাম বললেন কেন? কাজেই যারা এ ব্যাপারে বোখারী শরীফের দলীল দেয় তারা চরম জাহেল, ভন্ড, বেদ্য়াতী ও প্রতারক।
মূলকথা হচ্ছে- ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে বিবাহ অনুষ্ঠানসহ সকল স্থানেই “গান-বাজনা” করা হারাম। এটাকে হালাল বলা কূফরী। সুলতানুল হিন্দ গরীবে নেওয়াজ হাবীবুল্লাহ্ রহমতুল্লাহি আলাইহি জীবনে কখনো “গান-বাজনা” করেননি। আর বোখারী শরীফের কোথাও “গান-বাজনা” জায়েয বলা হয়নি।
(দলীলসমূহঃ- তাফসীরে কুরতুবী, আহ্কামুল কুরআন, তাবারী, মাযহারী, দুররে মানছুর, মাদারেক, মায়ালিম, রুহুল মায়ানী, রুহুল বয়ান, কবীর, আবী সাউদ, যাদুল মাসীর, জালালাইন, বায়হাক্বী, দায়লামী, মেশকাত, মেরকাত, ফাতহুল বারী শরহে বোখারী, ওমদাতুল ক্বারী শরহে বোখারী, এরশাদুস্ সারী শরহে বোখারী, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত তীবী, তা’লীকুছ ছবীহ, মোযাহেরে হক্ব, ফতওয়ায়ে আলমগীরী, খোলাছাতুল ফতওয়া, জামিউল ফতওয়া, মুহীত, মুগনী, হেদায়া, তাতারখানিয়া, ফতহুল ক্বাদীর, ফতওয়ায়ে আযীযী ইত্যাদি।)