“নিশ্চয়ই তোমাদের নিকট মহান আল্লাহ্ পাক-এর পক্ষ হতে এক মহান নূর এবং একখানা সুস্পষ্ট কিতাব এসেছে।” (সূরা মায়িদা-১৫)
উল্লেখ্য, এ আয়াত শরীফে মহান আল্লাহ্ পাক “নূর” শব্দ দ্বারা সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকেই বুঝিয়েছেন, যেহেতু তিনি আপাদমস্তক “নূর বা নূরের তৈরি।”
এ প্রসঙ্গে “তাফসীরে আবী সাউদ”-এর ৩য় জিঃ ১৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, “বর্ণিত আয়াত শরীফের প্রথম শব্দ অর্থাৎ ‘নূর’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো- “সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম; আর দ্বিতীয় শব্দ অর্থাৎ ‘কিতাবুম মুবীন’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো- কুরআন শরীফ।”
হাদীছ শরীফে উল্লেখ আছে, “হযরত জাবির রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আল্লাহ পাক্-এর রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললাম, ইয়া রসূলাল্লাহ্ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য কুরবান হয়ে যাক। আপনি আমাকে জানিয়ে দিন যে, আল্লাহ্ পাক সর্ব প্রথম কোন জিনিস সৃষ্টি করেছেন?
তিনি বললেন, হে জাবির রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু! নিশ্চয়ই আল্লাহ্ পাক সবকিছুর পূর্বে আপনার নবীর নূর মুবারককে সৃষ্টি করেছেন। অর্থাৎ আল্লাহ পাক-এর প্রথম সৃষ্টিই হচ্ছে “নূরে হাবীবী” ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।” (মসনদে আব্দুর রায্যাক)
সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে নূরের সৃষ্টি বা “নূরে মুজাস্সাম” তা নিম্নোক্ত বর্ণনা দ্বারাও প্রমাণিত হয়:
যেমন হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে, “হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন- হে আমার রব! আমাকে কি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন? জবাবে আল্লাহ্ পাক বলেন, হে হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আমি আমার (সৃষ্টিকৃত) সাদা নূর (যা নূরে হাবীবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর স্বচ্ছতা ও নির্মলতার প্রতি লক্ষ্য করলাম, যে নূরকে আমি কুদরতের দ্বারা আমার হুকুমে প্রথমেই সৃষ্টি করে রেখেছিলাম।
আমি সম্মান প্রকাশার্থে উক্ত নূরকে অর্থাৎ আমার নূর বলে সম্বোধন করি। অতঃপর উক্ত নূর থেকে একটি অংশ বের করে নিলাম অর্থাৎ “নূরে হাবীবী” ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তিন ভাগে ভাগ করলাম। প্রথম ভাগ দ্বারা আপনাকে অর্থাৎ আপনার আকৃতি মুবারককে ও আপনার আহলে বাইতকে সৃষ্টি করি, দ্বিতীয় ভাগ দ্বারা আপনার স্ত্রী ও ছাহাবীগণকে সৃষ্টি করি, আর তৃতীয় ভাগ দ্বারা যারা আপনার প্রতি মুহব্বত রাখেন তাঁদেরকে সৃষ্টি করেছি”.....(নূরে মুহম্মদী- ৪৭)”
অতএব, প্রমাণিত হলো যে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দেহ মুবারক সৃষ্টির উপাদান হচ্ছে- “মূল নূরে হাবীবী।” যে ‘নূরে হাবীবী’ হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম থেকে হযরত খাজা আব্দুল্লাহ্ আলাইহিস্ সালাম হয়ে মা হযরত আমিনা আলাইহাস্ সালাম-এর রেহেম শরীফে সম্পূর্ণ কুদরতীভাবে স্থান নিয়েছিল। আমাদের অবস্থা কিন্তু তার সম্পূর্ণই ব্যতিক্রম। যদি তাই হয়, তবে একথা কি করে বলা যেতে পারে যে, রসূল আমাদের মত।”
আকৃতিগতভাবে মেছাল আমাদের মত, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কোন দিক দিয়েই আমাদের মত নন, বরং তিনি আমাদের থেকে সৃষ্টিগত উপাদান, কর্মকাণ্ডে ও মর্যাদায় ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়ে সম্পূর্ণরূপে আলাদা অর্থাৎ এক কথায় সৃষ্টির মাঝে তাঁর তুলনা তিনি এককভাবে নিজেই। যেমন আল্লাহ্ পাক স্রষ্টা হিসেবে তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই। তদ্রুপ সৃষ্টির মধ্যে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এরও সমকক্ষ কেউ নেই। কোনদিক দিয়েই না।
“সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নূরে মুজাস্সাম বলেই তাঁর শরীর মুবারকের কোন ছায়া ছিল না।”
এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত ও প্রসিদ্ধ “নাওয়াদেরুল উছূল” কিতাবে হাদীছ শরীফ বর্ণিত আছে যে, হযরত হাকীম তিরমিযী রহমতুল্লাহি আলাইহি “নাওয়াদেরুল উছূল” কিতাবে হযরত জাকওয়ান রহমতুল্লাহি আলাইহি থেকে বর্ণনা করেন। নিশ্চয়ই সূর্য ও চাঁদের আলোতেও সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর “ছায়া মুবারক” দেখা যেত না।”
হযরত আল্লামা ইবনে সাবা রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর “শিফাউস সুদুর” কিতাবে লিখেছেন,
অর্থঃ- “নিশ্চয়ই হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম-এর ছায়া মুবারক যমীনে পড়তো না। কেননা তিনি ছিলেন নূর। অতঃপর যখন তিনি সূর্য অথবা চাঁদের আলোতে হাঁটতেন তখন তাঁর ছায়া মুবারক দৃষ্টিগোচর হতো না।”
এ প্রসঙ্গে “শরহে মাওয়াহেবুল লাদুন্নীয়া শরীফে” উল্লেখ আছে, “চাঁদ ও সূর্যের আলোতেও হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ছায়া মুবারক ছিল না। কেননা তিনি নূর ছিলেন।” (আর নূরের কোন ছায়া নেই)
ইমামুল আল্লাম, জালালু মিল্লাত ওয়াদ্বীন, আল্লামা জালালুদ্দীন সূয়ূতী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর “আনমুযাজুল লবীব ফী খাছায়িসিল হাবীব” ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দ্বিতীয় বাবের চতুর্থ অধ্যায়ে লিখেন- “হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ছায়া মুবারক মাটিতে পড়েনি। চাঁদ ও সূর্যের আলোতেও তাঁর ছায়া মুবারক দেখা যেতো না। হযরত আল্লামা ইবনে সাবা রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন- হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেহেতু সম্পূর্ণ নূর ছিলেন সেহেতু তাঁর ছায়া মুবারক ছিল না। হযরত ইমাম রাজীন রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, অবশ্যই হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নূর সমস্ত কিছুকে ছাড়িয়ে যেতো।”
এ প্রসঙ্গে “শেফা শরীফ” কিতাবে উল্লেখ আছে যে, “হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নূরের দেহ মুবারকের ছায়া মুবারক সূর্য ও চাঁদের আলোতেও পড়তো না। কেননা তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ নূর।”
অনুরূপভাবে “আফযালুল কোরায়” উল্লেখ আছে, “নিশ্চয়ই সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘নূর’ ছিলেন। নিশ্চয়ই তিনি যখন চাঁদ ও সূর্যের আলোতে হাঁটতেন তখন তাঁর ছায়া মুবারক প্রকাশ পেতো না।”
বিখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা শিহাবুদ্দীন খাফফাজী রহমতুল্লাহি আলাইহি “নাসীমুর রিয়াজ” নামক কিতাবে লিখেন যে, “সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর “নবুওওয়াতের” প্রমাণের মধ্যে এটাও একটি প্রমাণ যে, তাঁর শরীর মুবারকের ‘ছায়া মুবারক’ ছিল না। যখন তিনি সূর্য ও চন্দ্রের আলোতে হাঁটতেন তখনও তাঁর “ছায়া মুবারক” পড়তো না। কেননা তিনি (আপাদ মস্তক) “নূর”। ... কিতাবুল ওয়াফা-এর লেখক, হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণনা করেন, “সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর “ছায়া মুবারক” ছিল না। তাঁর নূরের উজ্জলতা সূর্য ও বাতির আলোর উপর প্রাধান্য লাভ করতো ...।”
এ প্রসঙ্গে “ফয়জুল ক্বাদীর শরহে জামিউছ্ ছগীর” কিতাবের ৩য় জিঃ, ৭৬৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, “হযরত আবুল উজাফা হতে বর্ণিত, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আমার বিলাদতের সময় আমার মাতা হযরত আমিনা আলাইহাস্ সালাম দেখেন যে, একখানা “নূর মুবারক” তাঁর থেকে আলাদা হয়ে বছরা শহরের দালান-কোঠা সমূহ আলোকিত করে ফেলেছে।”
“বুলুগুল আমানী” কিতাবের ২০ জিঃ, ১৮৩ পৃষ্ঠায় এ হাদীছ শরীফখানা বর্ণিত আছে যে, “হযরত ওসমান ইবনে আবিল আছ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন, যে রাত্রে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিলাদত লাভ করেন, সে রাত্রে আমার মাতা হযরত আমিনা আলাইহাস্ সালাম-এর নিকট উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, সে রাত্রে আমি ঘরের ভিতর ‘নূর’ ব্যতীত কিছুই দেখিনি।”
শুধু তাই নয়, আরশ-কুরসী, লউহ-ক্বলম, জান্নাত-জাহান্নাম, চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-তারকা এমনকি সমস্ত কুল-ক্বায়িনাত সৃষ্টি হয়েছে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নূর মুবারক থেকে।
এ প্রসঙ্গে বিশ্বখ্যাত কিতাব মাদারিজুন নুবুওওয়াতে উল্লেখ আছে,
“আল্লাহ পাক সর্ব প্রথম আমার নূর মুবারক সৃষ্টি করেছেন, এবং সব কিছুই সৃষ্টি হয়েছে আমার নূর মুবারক থেকে।”
তিনি যখন রাস্তায় চলতেন তখন সেই রাস্তায় নূরে ঝলমল করত। তিনি আপাদমস্তক নূর তার জ্বলন্ত প্রমাণ হল হযরত আয়িশা ছিদ্দিক্বা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা-এর বর্ণিত হাদীছ শরীফ। যেমন- হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাত্রে বাতির আলোতে বসে নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাপড় মুবারক সিলাই করতেছিলাম। এমন সময় বাতিটি নিভে গেল এবং আমি সুঁচটি হারিয়ে ফেললাম। এর পরপরই নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার ঘরে প্রবেশ করলেন। তাঁর চেহারা মুবারকের নূরের আলোতে আমার অন্ধকার ঘর আলোকময় হয়ে গেল এবং আমি নূরের আলোতে আমার হারানো সুঁচটি খুজে পেলাম। (সুবহানাল্লাহ)
কাজেই কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াসের অসংখ্য দলীল আদিল্লাহ এর ভিত্তিতে প্রতিভাত হলো যে, আখিরী নবী হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নূরে মুজাস্সাম তথা আপাদমস্তক নূর, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ করলে কাফির হওয়া ছাড়া কোন পথই নেই। যার সাক্ষী স্বয়ং আল্লাহ পাক।
পরিশেষে মহান আল্লাহ পাক-এর দরবার শরীফে এই আরযী যে, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নূরে মুজাস্সাম তথা আপাদমস্তক নূর এই আক্বীদায় আক্বীদাভুক্ত করে আল্লাহ পাক-এর সন্তুষ্টি এবং হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সন্তুষ্টি রিযামন্দী হাছীল করার তাওফীক্ব দান করুন। (আমীন)