নোটিশ

শনিবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১১

হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ উনাদের মুহব্বত ঈমানের অঙ্গ এবং উনাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা কুফরী

এ প্রসঙ্গে কালামুল্লাহ শরীফে ইরশাদ হয়েছে, “নিশ্চয়ই যারা আল্লাহ পাক ও উনার রসুল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে কষ্ট দেয়, দুনিয়া ও আখিরাতে তাদের প্রতি আল্লাহ পাক-উনার অভিসমপাত এবং তাদের জন্য নির্ধারিত রয়েছে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি।” (সূরা আহ্‌যাব-৫৭)

এ আয়াত শরীফের ব্যাখ্যায় আল্লাহ পাক-উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, “আমার ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ সমপর্কে আল্লাহ পাককে ভয় কর, আমার ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ সমপর্কে আল্লাহ পাককে ভয় কর। আমার বিছাল (ওফাত) শরীফের পরে তাঁদেরকে তোমরা তিরষ্কারের লক্ষ্যস্থল করো না। যে ব্যক্তি তাঁদেরকে মুহব্বত করলো, সে আমাকে মুহব্বত করার কারণেই মুহব্বত করলো, আর যে ব্যক্তি তাঁদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করলো, সে আমার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করার কারণেই তা করলো। যে ব্যক্তি তাঁদেরকে কষ্ট দিল, সে মূলত: আমাকেই কষ্ট দিল, আর যে ব্যক্তি আমাকে কষ্ট দিল, সে মূলত: আল্লাহ পাককেই কষ্ট দিল, আর যে আল্লাহ পাককে কষ্ট দিল, আল্লাহ পাক তাকে শীঘ্রই পাকড়াও করবেন।” (তিরিমিযী শরীফ)

আল্লাহ পাক আরো ইরশাদ করেন, “একমাত্র কাফিররাই তাঁদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে।” (সূরা ফাতহ্‌-২৯) এই আয়াত শরীফের ব্যাখ্যায় হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে, “যে ব্যক্তি হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করবে, সে কাফির। (মিশকাত শরীফ) হাদীছ শরীফে আরো ইরশাদ হয়েছে, “হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের প্রতি মুহব্বত ঈমান, আর তাঁদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা কুফরী।” (কানযুল উম্মাল)

হাদীছ শরীফে আরো ইরশাদ হয়েছে, “হযরত আবু বকর ছিদ্দীক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এবং হযরত উমর ফারুক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর মুহব্বত ঈমানের অন্তর্ভুক্ত, আর তাঁদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ কুফরী। (বুখারী শরীফ)

হাদীছ শরীফে আরো ইরশাদ হয়েছে, “তোমরা আমার ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণকে গালি দিও না। কেননা যদি তোমাদের কেউ উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণ আল্লাহ পাক-উনার রাস্তায় দান করে, তবুও ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের এক মূদ (১৪ ছটাক) বা অর্ধ মূদ (৭ ছটাক) গম দান করার ফযীলতের সমপরিমাণ ফযীলতও অর্জন করতে পারবে না। (বুখারী শরীফ)

অতএব, সকল হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ সমপর্কেই আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। কারণ, হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম মাত্রই সম্মান ও তা‘যীম-তাকরীম এবং মুহব্বতের পাত্র।

অথচ আজকাল অনেকেই হযরত উসমান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু সহ সকল ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের এবং বিশেষ করে হযরত মু‘য়াবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু -এর ব্যাপক সমালোচনা করে থাকে। তাঁদের সমালোচনা করতে গিয়ে যুক্তি পেশ করে থাকে যে, যদি তাঁরা হক্বের উপর থাকতেন, তবে হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর সাথে হযরত মুয়াবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু -এর জিহাদ হলো কেন ? দু’দলের মধ্যে একদল নিশ্চয়ই হক্ব ও অপর দল নাহক্ব।

মূলত: হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারীদের উক্ত যুক্তি মোটেও শুদ্ধ নয়। তার প্রমাণ আল্লাহ পাক কুরআন শরীফেই উল্লেখ করেছেন। যেমন আল্লাহ পাক বলেন, “হে হাবীব! (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপনি বলুন, প্রত্যেকেই তার অভ্যাস বা আদত অনুযায়ী আমল করে থাকে। তবে তোমাদের রব ভালো জানেন কে অধিক সুপথে রয়েছে । (সূরা বণী ইসরাঈল-৮৪)

এ আয়াত শরীফ থেকে মুফাস্‌সিরীনে কিরাম দু’টি পথ নির্ধারণ করেছেন। একটি হলো সুপথ, অপরটি হলো অধিক সুপথ। কাজেই হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের মধ্যে যে জিহাদ হয়েছে, ইখতিলাফ বা মতবিরোধ হয়েছে, তাতে কেউ সুপথে ছিলেন, আর কেউ অধিক সুপথে ছিলেন। অর্থাৎ প্রত্যেকেই হক্বের মধ্যে ছিলেন, কেউই নাহক্বের মধ্যে ছিলেন না।

পূর্বোক্ত আলোচনা দ্বারা প্রমানিত হয়েছে যে, হযরত মুয়াবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু সহ প্রত্যেক ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুই হক্বের উপর কায়িম ছিলেন । এ সমপর্কে হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে, হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত- হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন : আমার বেছাল (ওফাত) শরীফের পরে আমার ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের ইখতিলাফ (মতবিরোধ) সমপর্কে আমি আল্লাহ পাককে জিজ্ঞাসা করেছি । আল্লাহ পাক আমাকে বললেন : হে হাবীব, নিশ্চই আপনার ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ আমার নিকট তারকা সমতূল্য। কারো আলোর চেয়ে কারো আলো বেশী, তবে প্রত্যেকেরই আলো আছে । সুতরাং, তাঁদের যে কোন ইখতিলাফকে যারা আঁকড়িয়ে ধরবে, তারা হিদায়েত পেয়ে যাবে । কারণ তাঁদের ইখতিলাফগুলো আমার নিকট হিদায়েত হিসাবে গণ্য। অত:পর রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন: আমার ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ (প্রত্যেকেই) তারকা স্বদৃশ, তাঁদের যে কেউকে তোমরা অনুসরণ করবে, হিদায়াত প্রাপ্ত হবে।

বুঝা গেল যে, হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের ইখতিলাফও হিদায়াতের কারণ এবং আল্লাহ পাকের নিকট গ্রহণযোগ্য । অর্থাৎ তাঁদের যে কাউকে, যে কোন ব্যক্তি, যে কোন বিষয়ে অনুসরণ করবে, সে ব্যক্তি সে বিষয়েই হিদায়াত লাভ করবে বা হিদায়াতের উপর থাকবে ।

হযরত মুয়াবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর ফযীলত সমপর্কে যিনি ইমামে আ‘যম হযরত আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি -এর বিশিষ্ট ছাত্র ও খলীফা আমিরুল মু’মিনীন ফিল হাদীছ, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক রহমতুল্লাহি আলাইহিকে জিজ্ঞাসা করা হলো যে, হযরত মুয়াবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু শ্রেষ্ঠ, না হযরত উমর ইবনে আব্দুল আযীয রহমতুল্লাহি আলাইহি শ্রেষ্ঠ ? তিনি বলেন, আল্লাহ পাক-উনার কসম ! হযরত মুয়াবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু যখন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার সাথে ঘোড়ায় চড়ে জিহাদে যেতেন, তখন ঘোড়ার নাকে যে ধূলাবালিগুলো প্রবেশ করতো, সে ধুলাবালিগুলোও হযরত উমর ইবনে আব্দুল আযীয রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর ন্যায় শত শত ব্যক্তি হতেও শ্রেষ্ঠ, সুবহানাল্লাহ। (ফতওয়ায়ে হাদীছিয়াহ)

সুতরাং, উপরোক্ত কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফের আলোচনা দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করা, তাঁদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা এবং তাঁদেরকে (নাকিছ) অপূর্ণ বলা সমপূর্ণ হারাম ও কুফরী । মূলত: ইসলাম বিদ্বেষীদের আন্তর্জাতিক একটি চক্রান্ত যে, হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণকে দোষারোপ করা। হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণকে অপূর্ণ বাতিল সাব্যস্ত করতে পারলে কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ তথা দ্বীন ইসলাম বাদ হয়ে যাবে । কাজেই ইসলাম বিদ্বেষীদের চক্রান্ত সমপর্কে আমাদের সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে । আর সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার বেছাল (ওফাত) শরীফের পরে যে ছাহাবা বিদ্বেষী নামে ইসলাম ধ্বংসকারী একটি দল আত্মপ্রকাশ করবে, সে সমপর্কে তিনি উম্মতের প্রতি সতর্ক করে ভবিষ্যদ্বাণীতে ইরশাদ করেন, “অতি শীঘ্রই একটি দল বের হবে, যারা আমার ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণকে গালি দিবে, তাঁদেরকে নাকিছ বা অপূর্ণ বলবে । সাবধান ! তোমরা তাদের মজলিসে বসবে না, তাদের সাথে পানাহার করবে না, তাদের সাথে বিয়ে শাদির ব্যবস্থা করবে না। অন্য রেওয়ায়াতে উল্লেখ রয়েছে, তাদের পিছনে নামায পড়বে না এবং তাদের জন্য দোয়া করবে না ।” তিনি আরো ইরশাদ করেন, যখন তোমরা কাউকে আমার ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণকে গালি দিতে দেখবে, তখন তোমরা বলো, এ নিকৃষ্ট কাজের জন্য তোমাদের প্রতি আল্লাহ পাক-উনার লা‘নত বর্ষিত হোক । (তিরমিযী শরীফ)

প্রসিদ্ধ সীরাত গ্রন্থ’তে বর্ণিত আছে, আল্লাহ পাক-উনার হাবীব, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, “আমার ছাহাবাদের আলোচনাকালে তোমরা সংযত থেকো।” হানাফী মায্‌হাবের ইমাম, ইমামে আ‘যম হযরত আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি বিশ্ববিখ্যাত কিতাব ‘‘ফিকহুল আকবরে’’ উল্লেখ করেন, ‘আমরা হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার প্রত্যেক ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ সমপর্কেই সুধারণা পোষণ করি ।’ বিশ্বখ্যাত মুহাদ্দিছ হাফিয ইবনে হাজার আছকালানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার বিখ্যাত গ্রন' ‘‘ইছাবা’’-এর ১ম খণ্ডে প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিছ হাফিয্‌ আবু যার‘আ রাযী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর নিম্নোক্ত বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন, যখন কাউকে দেখবে যে সে কোন একজন ছাহাবা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর অবমাননা করছে তখন তুমি জানবে- সে ব্যক্তি নির্ঘাত যিন্দিক তথা কাফির ।

অতএব, আমাদের প্রত্যেককেই হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের প্রতি সুধারণা পোষণ করতে হবে, তাঁদেরকে মুহব্বত ও যথাযথ তা‘যীম-তাকরীম করতে হবে এবং তাঁদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা যাবে না, তাঁদের কোনরূপ সমালোচনা ও তাঁদেরকে নাকিছ বা অপূর্ণ বলা যাবে না । কারণ শরীয়তের ফায়সালা হলো, হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের প্রতি মুহব্বত রাখা, তাঁদের যথাযথ তা‘যীম-তাকরীম করা ঈমানের অঙ্গ এবং তাঁদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা কুফরীর অন্তর্ভুক্ত।