নোটিশ

বুধবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১১

ফিতরা আদায়ের হুকুম-আহকাম


ঈদুল ফিতর-এর দিন মালিকে নিছাব-এর উপর শরীয়ত নির্ধারিত পরিমাপে ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব। প্রত্যেক মু’মিন-মুসলমানের দায়িত্ব কর্তব্য হচ্ছে  ঈদুল ফিতর-এর দিন নামাযের পূর্বেই ফিতরা আদায় করা। কেননা নামাযের পূর্বে আদায় করাই খাছ সুন্নত এবং অধিক ফযীলতের কারণ। ছদাক্বাতুল ফিতর আদায় না করলে  রোযাসমূহ আসমান ও যমীনের মাঝখানে ঝুলে থাকে । রোযার মধ্যে কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি হলে ছদাক্বাতুল ফিতর আদায়ের দ্বারা তা দূর হয়ে যায়।

ফিতরার পরিমাণঃ
যাদের উপর ছদাক্বাতুল ফিতর ওয়াজিব অর্থাৎ ঈদের দিন ছুবহি ছাদিক্বের সময় যাদের নিকট নিছাব পরিমাণ (সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ অথবা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা অথবা এর সমপরিমাণ মূল্য) সম্পদ থাকে
তাদের প্রত্যেককেই নিজ নিজ এলাকা অনুযায়ী “১ সের সাড়ে ১২ ছটাক বা ১৬৫৭ গ্রাম আটা বা এর সমপরিমাণ মূল্য দান করতে হবে।

ফিতরা নির্ধারণের দলীল-আদিল্লাহ

নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন, ছদকাতুল ফিতর- এক সাগম বা আটা দুই ব্যক্তির পক্ষ থেকে আদায় করতে হবে। অর্থাৎ একজনের জন্য অর্ধ সা’  আর অর্ধ সাহচ্ছে ১ সের সাড়ে ১২ ছটাক বা ১৬৫৭ গ্রাম।

২০১২ ঈসায়ী সনে ঢাকা শহরে আটা ৩৪.৫০ টাকা কেজি হিসেবে ছদাকাতুল ফিতর হলো ৫৮ টাকা প্রায়।
হানাফী মাযহাব মতে ছদকাতুল ফিতরের পরিমাণ নির্ধারণ করতে হবে কেবল গম তথা আটার মূল্যে।
দেশের প্রধান খাদ্য দিয়ে ছদকাতুল ফিতর আদায় করা; এটা মূলত লা-মাযহাবীদের ফতওয়া।
কাজেই চালের হিসেবে ছদকাতুল ফিতর নির্ধারণ করা সম্পূর্ণরূপে মনগড়া ও ভুল।
অতএব, সকলের জন্য ফরয-ওয়াজিব হলো যে কোনো বিষয়ে ভুল ফতওয়া দান ও প্রচার করা থেকে বিরত থাকা।
আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ছদকাতুল ফিতরের পরিমাণ সম্পর্কে ইরশাদ করেন- হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে সালাবা অথবা সালাবা ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আবু সুআইর উনার পিতা হতে বর্ণনা করেন যে, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি তিনি ইরশাদ করেন, এক সাগম বা আটা দুব্যক্তির পক্ষ থেকে আদায় করতে হবে- ছোট হোক বা বড় হোক, আযাদ হোক বা গোলাম হোক এবং পুরুষ হোক বা মহিলা হোক। (আবূ দাউদ শরীফ, মিশকাত শরীফ)
আমাদের হানাফী মাযহাব মুতাবিক অর্ধ সাবলতে ১ সের সাড়ে ১২ ছটাক বুঝানো হয়েছে, যা গ্রাম হিসাবে ১৬৫৭ গ্রাম (প্রায়) হয়।
যাদের উপর ছদকাতুল ফিতর ওয়াজিব অর্থাৎ ঈদের দিন ছুব্হে ছাদিকের সময় যাদের নিকট নিছাব পরিমাণ (সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ অথবা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা অথবা এর সমপরিমাণ মূল্য, যা বর্তমানে ১,৪৫৮ টাকা তোলা হিসেবে ৭৬,৫৫৪ টাকা) সম্পদ থাকে, তাদের প্রত্যেককেই উল্লিখিত ১ সের সাড়ে ১২ ছটাক বা ১৬৫৭ গ্রাম আটা বা তার মূল্য দান করতে হবে।
দেশের বিভিন্ন এলাকায় আটার দাম বিভিন্ন রকম। কাজেই যাদের উপর ছদকাতুল ফিতর ওয়াজিব, তাদেরকে বর্তমান মূল্য হিসাবে একসের সাড়ে বার ছটাক বা ১৬৫৭ গ্রাম আটার মূল্য হিসাবে দিতে হবে। এ বছর ২০১২ ঈসায়ী সনে ঢাকা শহরে ৩৪.৫০ টাকা কেজি হিসাবে এক সের সাড়ে বার ছটাক বা ১৬৫৭ গ্রাম আটার মূল্য- ৫৮ টাকা (প্রায়)।যেমন, ১ কেজি বা ১০০০ গ্রাম আটার মূল্য ৩৪.৫০ টাকা। প্রতি গ্রাম আটার মূল্য ৩৪.৫০স্ট১০০০= ০.০৩৪৫ টাকা। ১৬৫৭ গ্রাম আটার মূল্য ১৬৫৭x০.০৩৪৫=৫৭.১৬৬৫ টাকা অর্থাৎ ৫৮ টাকা (প্রায়)। এর কম দেয়া যাবে না । তবে ইচ্ছা করলে বেশি দিতে পারবে।
ফতওয়ায়ে আলমগীরী, ক্বাযীখান, বাহরুর রায়িক, হিদায়া, আইনুল হিদায়া ইত্যাদি সুপ্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য ফিক্বাহ ও ফতওয়ার কিতাবে উল্লেখ রয়েছে, হানাফী মাযহাবে শুধুমাত্র গম তথা আটার মূল্যে ছদকাতুল ফিতর আদায় করতে হবে। অন্যকিছু দিয়ে ছদকাতুল ফিতর আদায় করা যাবে না।
দেশের প্রধান খাদ্য দিয়ে ছদকাতুল ফিতর আদায় করা- এটা মূলত লা-মাযহাবীদের ফতওয়া। কাজেই সে ফতওয়া কোনো মাযহাবপন্থীদের অনুসরণ বা আমল করা জায়িয নেই। এছাড়া এক মাযহাবের অনুসারীর জন্য অন্য মাযহাবের ফতওয়া বা মাসয়ালা অনুসরণ করাও জায়িয নেই।
তাফসীরে আহমদিয়া, কিমিয়ায়ে সায়াদাত, ইকদুলজিদ, ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন, আত তাহরীর, জাযীলুল মাযাহিব, আল মালূমা, মুসাল্লাম, জামিউল জাওয়ামে, হারী, ইনছাফ, তাফসীরে আযীযী, ছিফরুস সায়াদাত ইত্যাদি কিতাবে উল্লেখ রয়েছে, প্রত্যেকের জন্য মাযহাব চতুষ্ঠয়ের যে কোনো এক মাযহাবের অনুসরণ করা ফরয-ওয়াজিব। অন্যথায় সে ফাসিক ও গোমরাহ্ হবে। এ ফতওয়ার উপর ইমাম-মুজতাহিদগণ উনারা ইজমা করেছেন।
তাফসীরে আহমদিয়া, কিমিয়ায়ে সায়াদাত, ইকদুলজিদ, ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন, আত তাহরীর, জাযীলুল মাযাহিব, আল মালূমা, দুররুল মুখতার ইত্যাদি কিতাবে উল্লেখ রয়েছে, এক মাযহাব ছেড়ে অন্য মাযহাবে যেরূপ প্রত্যাবর্তন করা জায়িয নেই তদ্রুপ যে কোনো একটি মাসয়ালায় এক মাযহাবের অনুসরণ আবার অন্য একটি মাসয়ালায় অন্য এক মাযহাবের অনুসরণ করাও জায়িয নেই।
আবূ দাউদ ও মিশকাত শরীফ-এ উল্লেখ রয়েছে, হযরত আবূ হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বর্ণনা করেন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন, যাকে ইলম ব্যতীত ফতওয়া দেয়া হয়েছে অর্থাৎ ভুল ফতওয়া দেয়া হয়েছে (সে তদানুযায়ী আমল করার কারণে) তার সমুদয় গুনাহ যে ফতওয়া দিয়েছে তার উপরই বর্তাবে।
যে সব মুফতী, মাওলানা মাযহাব সম্পর্কে জ্ঞাত নয়, আক্বীদা ও আমলে ত্রুটি রয়েছে, দুনিয়ার মোহ রয়েছে, তাক্বওয়া বা খোদাভীতি নেই, সর্বোপরি ফতওয়া দেয়ার জন্য যে ইলমে লাদুন্নী থাকা শর্ত, তা নেই- সেসব মুফতী, মাওলানার ফতওয়া বা মাসয়ালা ভুল হওয়াই স্বাভাবিক।
যাদের দ্বীন বা শরীয়তের ইলম ও রূহানিয়ত নেই তাদেরকে উদ্দেশ্য করে মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ করেন, তোমরা আহলে যিকির বা আল্লাহওয়ালা অর্থাৎ হক্কানী-রব্বানী যারা আলিম উনাদেরকে জিজ্ঞেস করে জেনে নাও।আর যারা আলিম রয়েছেন তাদের দায়িত্ব হলো প্রদত্ত মাসয়ালা বা ফতওয়ার স্বপক্ষে দলীল পেশ করা। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তিনি নিজেই ইরশাদ করেন, তোমরা সত্যবাদী হলে দলীল পেশ করো সূরা বাক্বারা: আয়াত শরীফ-১১১।
গম ও আটা এ দুয়ের মধ্যে আটা দান করার মধ্যে গরিবদের ফায়দা বা উপকারিতা বেশি। কারণ এতে গরিবদের বাড়তি কোন শ্রম, ব্যয় ও ঘাটতি নেই। কিন্তু গমের মধ্যে শ্রম, ব্যয় ও ঘাটতি ইত্যাদি রয়েছে। যে কারণে এতে গরিবদের উপকার কম। ফলে, হানাফী মাযহাবে উন্নতমানের আটার মূল্যেই ছদকাতুল ফিতর আদায় করতে বলা হয়েছে।
অতএব, যারা বলে- দেশের প্রধান খাদ্য চালের হিসাব অনুযায়ী ফিতরা নির্ধারণ করতে হবে, এর স্বপক্ষে তাদেরকে দলীল পেশ করতে হবে। কেননা দলীল ব্যতীত কোনো ফতওয়া মুসলমানের জন্য অনুসরণীয় বা পালনীয় নয়। আর প্রকৃতপক্ষে তারা কোনো নির্ভরযোগ্য দলীলই পেশ করতে পারবে না।

ইফা প্রতিবার ভুল হিসাব করে

ইসলামিক ফাউন্ডেশন ফিতরা নির্ধারণে শুদ্ধ গাণিতিক হিসাব করতে না পারায় প্রতি বছরই তারা ফিতরা নির্ধারণে ভুল করে থাকে। প্রতি বছর ন্যায় এবারো এক সের সাড়ে বারো ছটাক অর্থাৎ ১৬৫৭ গ্রামের পরিবর্তে তারা ১৬৫০ গ্রাম হিসাব করে ফিতরা নির্ধারণ করেছে। কাজেই ফিতরা সম্পর্কে ইসলামিক ফাউন্ডেশন যে ফতওয়া দিয়েছে তা সম্পূর্ণই ভুল ও পরিত্যাজ্য।

শুদ্ধ গাণিতিক হিসাব করতে না পারায় প্রতিবছরই ইফা ফিতরা নির্ধারণে তিন ধরনের ভুল করে। প্রথমত, ১৬৫৭ গ্রামের স্থলে কমিয়ে ১৬৫০ গ্রাম নির্ধারণ করে। দ্বিতীয়ত, তারা খোলা বাজারের আটার দামে ফিতরা নির্ধারণ করে। অথচ খোলা বাজারের আটা গুণগত মানে ভাল নয় এবং তা ধনীরা তো নয়ই এমনকি মধ্যবিত্তরাও খায় না। তারা সবাই প্যাকেটের ভাল আটা খেয়ে থাকে। তারপরেও কথা হচ্ছে, প্যাকেটে আটা সব সময় ১ কেজি বা ২ কেজি পুরো থাকে না। অনেক সময় ২ কেজির প্যাকেটে থাকে ১৯৭৫ গ্রাম অথবা ১ কেজির প্যাকেটে ৯৭৫ গ্রাম বা ৯৮০ গ্রাম আটা থাকে। তৃতীয়ত, ইফা একই মূল্য শহর, গ্রাম তথা সারাদেশ ব্যাপী নির্ধারণ করে দেয়। অথচ বিভিন্ন অঞ্চলে দামের তারতম্য থাকতে পারে এবং সে হিসাবেই ফিতরার পরিমাণ নির্ধারণ হওয়া বাঞ্ছনীয়। কেননা দেশের বিভিন্ন এলাকায় আটার দাম বিভিন্ন রকম। কাজেই যাদের উপর ছদকাতুল ফিতর ওয়াজিব, তাদেরকে বর্তমান মূল্য হিসাবে এক সের সাড়ে বারো ছটাক বা ১৬৫৭ গ্রাম আটার মূল্য হিসেবে দিতে হবে।


তথ্যসূত্রঃ আল-ইহসান শরীফ আহ্‌কামু শাহরি রমাদ্বান